গত ১০ ডিসেম্বর ২০২০ পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের অনেক দিনের আশা পূর্ণ হতে চলেছে। দুই পাড় জোড়া লাগার দিন সাধারণ মানুষও যেভাবে উল্লসিত হয়ে দিনটিকে উদ্যাপন করেছে, তার নজির নিকট অতীতে দেখা যায়নি। গণমাধ্যমেও বহুল প্রচার পেয়েছে এই দিনটিতে দুই পাড় সংযুক্ত হওয়ার খবরটি। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি আগামী বছরের মাঝামাঝি জনগণের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়া হবে বলে আশা করি।
পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড গত ১২ মার্চ ২০২০ উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটির ঢাকার দিকে যাত্রাবাড়ী ইন্টারচেঞ্জ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে মাওয়া বা পদ্মা সেতুর উত্তর পাড় এবং ওপারে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ পাড় থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে ভাঙ্গা। বিশ্বমানের এই ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েটি নির্দেশ করে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টে কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে। পদ্মা সেতু জনগণের জন্য খুলে দেওয়ার বছর দুই আগেই এক্সপ্রেসওয়েটি খুলে দেওয়া হয়, যা এই প্রকল্পটির বিষয়ে দেশের একাগ্রতা ও সক্ষমতা নির্দেশ করছে।
এই এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে নদীবহুল এই দেশে চারটি রেলওয়ে উড়ালসেতু, পাঁচটি উড়ালসেতু, দুটি ইন্টারচেঞ্জ, ১৯টি আন্ডারপাস, চারটি বড় ও ২৫টি ছোট সেতু ও ৫৪টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েটির দুপাশে ছোট যানবাহনের জন্য সার্ভিস রোডও আছে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সেতু চালু হওয়ার অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সাধারণত মূল সেতু নির্মাণ শেষ হলেও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণে দেরি হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কার ইতি টানা হলো বছর দুই আগেই।
পদ্মা সেতু এতই বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা লিখে শেষ করা কঠিন। খরস্রোতা নদী পদ্মায় তিন মিটার ব্যাস ও কমবেশি ১০০ থেকে ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রায় তিন শটি পাইল গাড়তে হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে। পাইলের এমন গভীর ভিতের উদাহরণ পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। তিন মিটার সমান হলো একতলা ভবনের উচ্চতা আর ১৩০ মিটার হলো ৪২ তলা ভবনের সমান উঁচু। এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে দেশের প্রায় পাঁচ শ প্রকৌশলী ও কমবেশি চার হাজার শ্রমিক জড়িত রয়েছেন। নিজ খরচে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত ও আর্থিক দিক দিয়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে, সঙ্গে বেড়েছে আত্মবিশ্বাস।
পাটুরিয়ার সেতুটি একটি ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের আদলে নির্মিত হলে ভালো হয়। ওয়াই-এর ওপরের দুই অংশের বাঁ দিকেরটি দৌলতদিয়া ও ডান দিকেরটি নগরবাড়ী সংযোগ করবে এবং ওয়াই-এর গোড়ার দিকটি পাটুরিয়া সংযোগ করবে
নদীমাতৃক দেশে আরও সেতু দরকার। এই দরকার ছিল যুগ যুগ আগে থেকেই। তবে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক দিক দিয়ে দেশ সক্ষমতা অর্জন করার পর এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারবে বলে সময় এসেছে আরও সেতু নির্মাণের। মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল ২০০৪-০৫ সালে। সাধারণত সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় দু-তিন বা তারও বেশি জায়গার ওপর। পদ্মার ক্ষেত্রে পাটুরিয়া ও চাঁদপুর সম্ভাব্য যাচাই ক্ষেত্র হওয়ার কথা। প্রযুক্তিগত দিক ও আর্থসামাজিক দিক বিবেচনা করে পদ্মার ওপর মাওয়ায় সেতু নির্মাণ অগ্রাধিকার পেয়েছিল। এখন পাটুরিয়া ও চাঁদপুরে সেতু হওয়ার বিষয়টি সামনে আসছে এবং সেতু দুটি নির্মিত হওয়া সময়ের দাবি।
দুটির মধ্যে পাটুরিয়ার সেতুটি একটি ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের আদলে নির্মিত হলে ভালো হয়। ওয়াই-এর ওপরের দুই অংশের বাঁ দিকেরটি দৌলতদিয়া ও ডান দিকেরটি নগরবাড়ী সংযোগ করবে এবং ওয়াই-এর গোড়ার দিকটি পাটুরিয়া সংযোগ করবে। এই সেতু নির্মাণ করলে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। দুটির মধ্যে দ্বিতীয় সেতুটি চাঁদপুরে পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে বা দক্ষিণে সরে মেঘনায় ঢুকে নির্মিত হতে পারে। নির্ভর করছে প্রকৌশলগত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ওপর। বর্তমানে বৃহত্তর বরিশাল ও বৃহত্তর খুলনাবাসীকে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন যেতে ঢাকা হয়ে যেতে হয়। ফলে সময় লাগে দুদিন। অত্যন্ত বিড়ম্বনায় ভরা সেই যাতায়াত যদি ঢাকা না হয়ে সরাসরি চাঁদপুর হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এই সেতু দুটি নির্মাণে ২০০৫ সালের সম্ভাব্যতা যাচাই করার তথ্যগুলো কাজে লাগবে, যখন এই সেতু দুটির বিষয়ে আরও যাচাই-বাছাই করা হবে। মাওয়ার সেতুটি করতে গিয়ে আমাদের প্রকৌশলী ও সাধারণ কর্মীরা যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছেন, তা ভবিষ্যতে এমন বড় সেতু নির্মাণের কলাকৌশলসহ নানা দিকের জন্য সহায়ক হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক ও তার সঙ্গে অন্যান্য দাতা প্রতিষ্ঠান যেভাবে দূরে থেকেছে, তা আর ভবিষ্যতে ঘটবে না।
তা ছাড়া ২০১৪ সালে মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করার সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের কিছু বেশি, যা এখন প্রায় দ্বিগুণ বা ৪৩ বিলিয়নের ওপরে। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করার পরের বছর। অধিকন্তু, আরও দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করার জন্য মাওয়ার সেতু থেকে রাজস্ব আয় হবে বাড়তি আশীর্বাদ। সে জন্য মাওয়ার পদ্মা সেতুকে পাটুরিয়া ও চাঁদপুরের সেতুর মাদার ব্রিজ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণের ২২টি জেলার তিন কোটির অধিক লোক উপকৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে শতকরা ১ দশমিক ২ ভাগ জিডিপি বেড়ে যাবে বলে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা আরও দুটি সেতু নির্মাণ হওয়ার পর দ্বিগুণ বাড়ার কথা। দেশের অবস্থা আরও দুটি বড় সেতু নির্মাণে সবদিক দিয়েই সহায়ক। তাহলে আর দেরি কেন!
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ।
Leave a Reply