এগিয়ে চলেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। নির্মাণব্যয়ের মতোই সরকারের এ মেগা প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার খরচও তুলনামূলক বেশি। ফলে কেবল যাত্রী পরিবহন করে মেট্রোরেলের ব্যয় মেটানো কঠিন হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্রসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এ তথ্য জানিয়েছে।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রথম প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের। এর প্রতিটিতে বাড়তি আয়ের জন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলার এ পদ্ধতির নাম ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) হাব।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, শুরুতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন লাইন-৬–এর উত্তরা প্রান্তে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। এরপর প্রতিটি লাইনেই এক বা একাধিক স্থানে টিওডি হাব করা হবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশন হবে বহুতল। কোথাও স্টেশনের পাশে পর্যাপ্ত জমি পাওয়া না গেলে স্টেশন প্লাজাতেই বাণিজ্যিক দোকানপাট করার পরিকল্পনা রয়েছে।
চলমান লাইন-৬–এর উত্তরাংশে তিনটি স্টেশন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার এবং উত্তরা দক্ষিণ। পরিকল্পনা অনুসারে, প্রথম টিওডি হাব হবে উত্তরা সেন্টার স্টেশনকে ঘিরে। এর জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে ২৮ দশমিক ৬২ একর জমি কেনা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প থেকে ইতিমধ্যে জমির মূল্য হিসেবে রাজউককে প্রায় ৮৬৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে তুলনামূলক কম দামে জমি দিয়েছে রাজউক।
এখন বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হবে। মেট্রোরেল লাইন-৬–এর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোই–এর নেতৃত্বাধীন এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন টিওডি হাব নির্মাণের নকশা প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি ও দরপত্র দলিলসহ যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।
এ পরিকল্পনার বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, ‘টিওডি হাবে কী কী স্থাপনা নির্মাণ করা হবে, তা নকশা চূড়ান্ত হলে জানা যাবে। তবে মেট্রোরেল থেকে নেমে একজন মানুষ যাতে দরকারি সব পণ্য কিনতে পারেন, সেই ব্যবস্থা থাকবে। স্থাপনার ধরন ও সংখ্যার ওপর নির্মাণ ব্যয় নির্ভর করবে। বাণিজ্যিক প্রকল্পের জন্য সরকার নিজেই অর্থায়ন করতে পারে। জাপানসহ অন্য দেশ থেকেও ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে।’
সাবেক এই জ্যেষ্ঠ সচিব আরও বলেন, মেট্রোরেলের স্টেশন ঘিরে আয়বর্ধক বাণিজ্যিক স্থাপনা জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আছে। এ ধারণা থেকে বাংলাদেশকেও একই পথে হাঁটার পরামর্শ দেন জাপানি পরামর্শকেরা। এরপরই টিওডি হাব করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গাবতলীতে হবে টিওডি হাব
গাবতলী বাস টার্মিনালটি বর্তমানের জায়গা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় এ জায়গায় টিওডি হাব করতে চায় ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গাবতলী বাস টার্মিনালের জায়গায় টিওডি হাব হলে বর্তমানের অবকাঠামো ভেঙে ফেলার প্রয়োজন হবে না। বিষয়টি নিয়ে ডিএনসিসির সঙ্গে আলোচনা চলছে। শিগগিরই ডিএমটিসিএল ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতে তিনটি মেট্রোরেল, একটি সার্কুলার রেল ও একটি চার লেন সড়কের সংযোগস্থল হবে গাবতলী। এ জন্য সেখানে পরিকল্পিতভাবে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদনকেন্দ্র, বাস টার্মিনালসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুললে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের আয় বাড়বে।
আরও যেসব পরিকল্পনা
গাবতলী এলাকার তিনটি মেট্রোরেলের লাইনের পথ হচ্ছে লাইন-১ (গাবতলী থেকে ধানমন্ডি, গুলিস্তান হয়ে চিটাগং রোড), লাইন-৫ উত্তর পথ (সাভারের হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর ও গুলশান হয়ে ভাটারা), লাইন-৫ দক্ষিণ পথ (গাবতলী থেকে রাসেল স্কয়ার ও হাতিরঝিল হয়ে দাশেরকান্দি)। গাবতলী ছাড়াও এসব লাইনে একাধিক টিওডি হাব নির্মাণের পরিকল্পনা আছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের।
নির্মাণাধীন এমআরটি লাইন-৬ এর পর কাজ দ্রুত শুরু করার পরিকল্পনা আছে লাইন-১–এর। এই লাইনের দুটি অংশ। প্রথম অংশটি পাতাল পথে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত। দ্বিতীয় অংশটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে পূর্বাচলের পিতলগঞ্জে যাবে। এ লাইন নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ নকশা ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ চলছে। পূর্বাচলে একটি টিওডি হাব নির্মাণ করার পরিকল্পনা আছে।
উল্লেখ্য, মেট্রোরেলের ভাড়া ঠিক করতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি কাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোর ভাড়া খুব বেশি ধরার সুযোগ নেই। এতে মেট্রো জনপ্রিয়তা পাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তুলতে হলে বছর বছর ভর্তুকি দিতে হবে। এতে মেট্রোরেল দায়গ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। মূলত এ কারণে বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে টিওডি হাব খোলার মতো বাণিজ্যিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ খরচের কারণে সারা পৃথিবীতে মেট্রোরেলকে শ্বেতহস্তী মনে করা হয়। এ জন্য অনেক দেশেই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। টিওডির ধারণা আধুনিক ও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তবে টিওডি শুধু মেট্রোরেলকেন্দ্রিক বিষয় নয়। শুধু বিপণিবিতান নির্মাণ করলেই চলবে না। পুরো শহর পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ প্রকল্প নিজের টাকায় না করে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) করার পরামর্শ দেন তিনি। উৎস : প্রথম আলো।
Leave a Reply