অপার সৌন্দর্যঘেরা বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি এখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর নৈসর্গিক রূপ। বৈচিত্র্যময় সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির দ্বারপ্রান্তে। সেন্টমার্টিনের এমন পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে মূলত মানুষই বিশেষভাবে দায়ী। সেইন্টমার্টিন উপভোগ করতে কার না ভালো লাগে? প্রতিদিন গড়ে ৯-১০ হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে অবস্থান করে। কিন্তু ভ্রমণপিয়াসী এসব মানুষের পরিবেশবিরোধী আচরণের কারণে এর পরিবেশ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা মেলে গাংচিল পাখির। গাংচিলের এমন অবয়ব দৃশ্য দেখে পর্যটকেরা জাহাজ থেকে তাদের চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি খেতে দেয়। নিষিদ্ধ হলেও কে শোনে কার কথা। পর্যটকদের দেওয়া এসব খাদ্য পাখির জীবনকে মরণাপন্ন করে তুলছে, নাফ নদীতে কমেছে গাংচিলের সংখ্যা। এছাড়া ভ্রমণের সময় পর্যটকেরা চিপস, বিস্কুটের প্যাকেটসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য জাহাজ থেকে সাগরে ফেলছে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সামুদ্রিক বিভিন্ন জলজ ও উদ্ভিজ্জ প্রাণী। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। একটি পরিসংখ্যান বলছে, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে। ১৪ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক প্রতি বছর সমুদ্রে জমা হচ্ছে। সমুদ্রে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। খাদ্য হিসেবে ভুল করে প্লাস্টিক খাওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্নভাবে সেন্টমার্টিন দূষিত হচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে শৈবাল, প্রবাল, কচ্ছপ, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ ও উভচর প্রাণী এবং পাখিসহ নানা জীববৈচিত্র্য রয়েছে, কিন্তু ক্রমাগত দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব বিলুপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক প্রবাল। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে প্রবালশূন্য হয়ে পড়ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে তিন বর্গকিলোমিটারে। এছাড়া সমুদ্রে ডলফিন মৃত্যুর খবর নতুন কিছু নয়। প্রায়ই জেলেদের জালে ধরা পড়ে ডলফিন মাছ। ধরা পড়া এসব ডলফিন অনেক সময় জেলেরা মেরে ফেলে। এভাবে সমুদ্রে কমছে ডলফিনের সংখ্যা। সচেতন ও পরিবেশবান্ধব পর্যটকের অভাবে সেন্টমার্টিন ক্রমশ মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ আমাদের জাতীয় সম্পদ। সৌন্দর্যঘেরা লীলাভূমি সেন্টমার্টিনে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। তাই পর্যটন সম্ভাবনা ধরে রাখতে হলে সর্বপ্রথম প্রাণ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হব। সচেতন ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্থান বিদেশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে, কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মানুষ উদাসীন! করোনাকালে পর্যটকদের পদচারণা না থাকায় সেন্টমার্টিনসহ দেশের পর্যটন স্থানগুলো ফিরে পেয়েছিল তাদের চিরচেনা প্রকৃতিক রূপ। কিন্তু করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সেন্টমার্টিন হয়ে উঠেছে পর্যটনমুখর। পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে দ্বীপটি। তাই সরকারের এটি সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই দ্বীপে পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সবাইকে এখনই সজাগ হতে হবে। সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিত অভিযান পরিচালনাসহ আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে; তা না হলে এই দ্বীপ অচিরেই সাগরে বিলীন হয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার্থী, চট্টগ্রাম
Leave a Reply