সমুদ্রপথে ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রুট সুয়েজ খাল। গত ২৩ মার্চ ‘এমভি এভার গিভেন’ নামক বৃহৎ কনটেইনার জাহাজ আটকে এই খালটি ছয় দিন অবরুদ্ধ থাকায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ববাণিজ্য। এতে মিসরের পাশাপাশি শত কোটি ডলার লোকসানের ভাগীদার হয়েছে অনেক দেশ এবং কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। তবে ছয় দিনের মাথায় সুয়েজ খাল সচল হওয়ার পর মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি জানিয়ে দেন, দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। কিন্তু এ ঘটনায় নতুন করে বিশ্ববাণিজ্যের একটি বড় দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা, যা তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে।

সুয়েজ খাল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ব্যবসায়ীরা মনে করেন সুয়েজ খাল দিয়ে একটি জাহাজ পার হতে যে পরিমাণ অর্থ ও সময় সাশ্রয় হয় তা অতুলনীয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি জাহাজ ভারত থেকে ইতালির পথে রওনা হয়। সুয়েজ খাল দিয়ে অতিক্রম করলে জাহাজটিকে পার হতে হয় চার হাজার ৪০০ নটিক্যাল মাইল। ২০ নট গতিতে এ জাহাজ ৯ দিনে গন্তব্যে পৌঁছাবে। এর বাইরে একমাত্র বিকল্প পথটি হচ্ছে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে উত্তমাশা অন্তরীপ। ওই পথে একটি জাহাজ একই গতিতে গেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন সপ্তাহ। জাহাজটিকে অতিক্রম করতে হবে ১০ হাজার ৫০০ নটিক্যাল মাইল, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এমনকি পণ্য সময়মতো শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও বড় অন্তরায়।
ফলে এশিয়া-ইউরোপের বাণিজ্যে ব্যবসায়ীরা সুয়েজ খালের বিকল্প ভাবতে পারেন না। এ ছাড়া অন্য কোনো সংযোগ জলপথ নেই, যা দিয়ে বিশাল জাহাজ এশিয়া থেকে ইউরোপে যেতে পারে। সুয়েজ খালই একমাত্র ইউরোপকে আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর হয়ে এশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। ইউরোপকে অনেকাংশে সুয়েজ খালের ওপর নির্ভর করতে হয় এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের জ্বালানি, পোশাকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আনার ক্ষেত্রে। ফলে বিশাল কার্গো জাহাজ এভার গিভেন আটকে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি পণ্য নিয়ে ইউরোপ ও এশিয়া উভয় অঞ্চলেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ পথে প্রতিদিন ৯.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আসা-যাওয়া করে। ওই সংকটের সময় কিছু জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে যাত্রা করে। এতে তাদের অতিরিক্ত ছয় হাজার মাইল অতিক্রম করতে হয় এবং শুধু জ্বালানি খরচই বেড়ে যায় চার লাখ ডলার পর্যন্ত।
এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত নৌ রুট সুয়েজ খাল। এর দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার বা ১২০ মাইল। বিশ্ববাণিজ্যের ১২ শতাংশ পরিবহন হয় এই পথ দিয়ে। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্বের ১০ শতাংশ তেল বাণিজ্য এবং ৮ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের বাণিজ্য হয়ে থাকে, যা মূলত উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ইউরোপ যায়। বিশ্বের ২৪ শতাংশ শিপিং কনটেইনার এবং ইউরোপ-এশিয়া বাণিজ্যের সব শিপিং কনটেইনার এই পথ দিয়ে পার হয়।

বাংলাদেশের কী পরিমাণ পণ্য সুয়েজ খাল দিয়ে ইউরোপে রপ্তানি হয়, তার একটি আনুমানিক হিসাব দেন বিদেশি শিপিং লাইনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রধানত সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর হয়েই ইউরোপ-আমেরিকায় পণ্য যায়। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর হয়ে ২৯ হাজার একক কনটেইনার ও কলম্বো বন্দর হয়ে ২৪ হাজার একক কনটেইনার যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বিবেচনা করেই এই তথ্য পাওয়া গেছে। সে হিসাবে বন্দর দুটি হয়েই সুয়েজ খাল দিয়ে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয় ৫৩ হাজার একক।

মিসর লোহিত সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ স্থাপনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নিয়ে ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে খালটি খনন করে। এটি চালু হওয়ার পর থেকে কয়েকবারই সম্প্রসারণ করা হয় বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে। সর্বশেষ বাড়ানো হয় ২০১৫ সালে। তখন জাহাজগুলোর অপেক্ষার সময় কমাতে আরো ৩৫ কিলোমিটার নতুন খাল খনন করা হয়। গত জানুয়ারিতে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ওসামা রাবি বলেছিলেন, ‘করোনায় চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ২০২০ সালে দেশটির রাজস্ব ৫.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির জিডিপির ২ শতাংশের মতো। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, গার্ডিয়ান।
Leave a Reply