করোনা মহামারীতে টিকে থাকতে আগেই কর্মীদের বেতন-ভাতা কর্তন করেছিল জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সংস্থাটি এখন পাইলটদের বেতন কমানোর চিন্তা করছে। এ লক্ষ্যে অন্যান্য দেশের পাইলটদের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের পাইলটদের বেতন-ভাতার তুলনামূলক পর্যালোচনা হচ্ছে। বিমানের বোর্ডসভায় প্রস্তাব উত্থাপনের কথা ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতামত নেওয়ারও চিন্তা সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল সরাসরি মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, বিমানের সঙ্গে চুক্তি হয় বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা)। পাইলটদের বেতনের বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি বোর্ড মিটিংয়ের ব্যাপার। বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে।

বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত পাইলট ১৪৪ জন। করোনা মহামারীতে ফ্লাইট বন্ধ থাকার মধ্যে গত বছরের ৫ মে বিমানের পাইলট, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমানো হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং পাইলটদের বেতন ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ কর্তন করা হয়। একই সঙ্গে স্থায়ী প্রকৃতির ভাতা ফুড সাবসিডি, মিল ও মিল্ক অ্যালাউন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া পাইলটদের ওভারটাইম, প্রডাক্টিভিটি অ্যালাউন্স, ফ্লাইং অ্যালাউন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বেতন কর্তনের সিদ্ধান্তে অখুশি পাইলট ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে হবে। প্রতিষ্ঠান টিকলেই পাইলটসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই বাঁচবেন। বিমানের পাইলটদের বেতন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের তুলনায় বেশি। এর চেয়েও বড় কথা- একজন মানুষের জন্য ১৫ লাখ টাকা মাসিক বেতন কি করোনাকালেও জরুরি? করোনা মহামারীর কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশ বিমানও সংকটে পড়েছে। ফলে পরিচালনা পর্ষদ পাইলটসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমিয়েছে। চাকরিতে নতুন যোগ দেওয়া একজন পাইলটের বেতন ৫০ শতাংশ কাটার পরও যদি দেড় লাখ টাকা পান, এটা কি কম?
বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের পর্যালোচনায় বলছে, কোভিডের আগে বিমানের ক্যাপ্টেনের বেতন দেওয়া হতো ১৩ হাজার ৩৭১ থেকে ১৪ হাজার ৬৬৪ মার্কিন ডলার। ভারতে করোনার আগে দেওয়া হতো ক্যাপ্টেনকে ৯ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার। ফার্স্ট অফিসারের জন্য বিমান করোনার আগে দিত ৭ হাজার ৯৪ থেকে ৯ হাজার ৩৯৮ ডলার। ভারতে একজন ফার্স্ট অফিসারকে তখন দেওয়া হতো ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার ডলার। করোনার পর বাংলাদেশ বিমান তাদের ক্যাপ্টেনকে দিচ্ছে ৫ হাজার ৪২২ ডলার বা ৪ লাখ ৬০ হাজার ৬০০ টাকা। ফার্স্ট অফিসারকে দেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ৯৪৩ ডলার বা আড়াই লাখ টাকা। আর ভারতে ক্যাপ্টেনের জন্য বেতন ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২০০ ডলার বা ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯০ টাকা আর ফার্স্ট অফিসারের জন্য ১ হাজার ৬০০ ডলার বা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯২০ টাকা। ফার্স্ট অফিসারের বেলায় ১০ বছর ও ক্যাপ্টেনের ক্ষেত্রে ২০ বছর উড্ডয়ন অভিজ্ঞতাকে এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

করোনার সময়ে কখনো কখনো ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন পাইলটরা। বিমান মাসে গড়ে ৩০ উড্ডয়ন ঘণ্টা ধরেছে। বিমানে ৩০ বছর বা তার বেশি কর্ম অভিজ্ঞতাধারীদের সর্বসাকল্যে বেতন ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৫৬ টাকা। করোনাকালে পাচ্ছেন ৫ লাখ ১ হাজার ১২৪ টাকা। ২৫ বছর বা তার ঊর্ধ্বকালে চাকরিরত পাইলটদের বেতন ১২ লাখ ৯১ হাজার ৮৫৬ টাকা। ৪ লাখ ৫০ হাজার ৩১৭ টাকা এখন তারা পাচ্ছেন। ২০ বছরের অভিজ্ঞ পাইলটদের বেতন ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৭০১ টাকা। বর্তমানে তারা পাচ্ছেন ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫৮২ টাকা। ১৫ বছরের অভিজ্ঞদের জন্য ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯২ টাকা বেতন। করোনাকালে পাচ্ছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭১২ টাকা। কর্মজীবন ১০ বছর হলে বেতন দেওয়া হয় ৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, এখন পাচ্ছেন আড়াই লাখ টাকা। কর্মজীবন পাঁচ বছর হলে বেতন ৬ লাখ ২ হাজার ৬১৭ টাকা, যা এখন ২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। নতুনদের জন্য ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা, এখন তারা পাচ্ছেন ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। ভারতে করোনার আগে ক্যাপ্টেনের জন্য ৯ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার দেওয়া হতো ভাতাসহ। ফার্স্ট অফিসারকে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার। করোনাকালে একেকজন ক্যাপ্টেন প্রতি উড্ডয়ন ঘণ্টার জন্য পান ৯০ ডলার। তার সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ ডলার নির্ধারিত সব ভাতাসহ। ফার্স্ট অফিসারের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ৩০ ডলারের সঙ্গে মাসে ৭০০ ডলার নির্ধারিত আছে।
এসব বিবেচনা করে বিমানের ১৫ লাখ টাকা বেতনভোগী পাইলটকে প্রায় ১২ লাখ টাকা বেতন দেওয়ার প্রস্তাব করা হতে পারে। মূল বেতন, হাউস রেন্ট, কিট, টেলিফোন ও ইন্টারনেট ভাতা, বিশেষ ভাতা, রিফিউজড ডে অফ, প্রডাক্টিভিটি ভাতাও থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে সুপারভাইজরি ক্যাপ্টেন ভাতা ও ইনস্ট্রাক্টর ভাতাও ধরা হয়। বিমানের পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই সর্বশেষ চুক্তি হয়েছে বলে বিমানের নথিতে দেখা যায়। চুক্তির মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩০ জুন। তবে মেয়াদ পার হলেও তা চলমান রাখার সুযোগ আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাপা সদস্যরা বলছেন, পাইলটরা বিরতিহীনভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেও ওভারটাইম ভাতা পাননি। অনেক পাইলট সপরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো চিকিৎসা ভাতা পাননি। বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে করা কাজের চুক্তি ভঙ্গ করেছে। করোনাকালে বেতন কমানো, ভাতা বন্ধের আগে বিমান কর্তৃপক্ষ পাইলটদের মতামতগুলো গ্রাহ্য করেনি। এ নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষের একটি অংশ বলছে, বিমানকে পাইলটের জন্য বাপার সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। ফলে তাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়া হয়। সংস্থার স্বার্থ বিবেচনায় রাখে না বেতনভোগী হয়েও। তাই বাপার সঙ্গে চুক্তির পরিবর্তে সরাসরি বিমান পাইলটদের নিয়োগ দিতে পারে কিনা- অন্যান্য দেশে এ ক্ষেত্রে নিয়ম কী এবং আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিধান কী, তা খতিয়ে দেখতে চায় সংস্থাটি।

বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, নিজস্ব আয়ে বিমান পরিচালিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বাজেট নেই। প্রতি মাসে উড়োজাহাজ কেনা বাবদ কিস্তি, বিমান কিস্তি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রায় ২২০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলসহ অপারেশনাল কাজের জন্য বিমান সোনালী ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ নিয়েছে। আরও ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিমান তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম গত বছরের মার্চ থেকে সীমিত করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে বিমানের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে স্বাভাবিক অবস্থায় পরিচালিত ফ্লাইটের মাত্র ৩৫ শতাংশ কার্যক্রম চলছে। ফলে এ ক্ষেত্রেও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ বিমান। এমন বাস্তবতায় সংস্থাটিকে টিকিয়ে রাখতে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে পাইলটদের বেতন হার নির্ধারণের ব্যাপারে জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। উৎস : আমাদের সময়।
Leave a Reply