নদীপথে কন্টেনার পরিবহনে আগ্রহ নেই আমদানিকারকদের। ফলে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে নির্মিত অনেক আশার পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল আশানুরূপ কাজে লাগছে না। সময় বেশি লাগার পাশাপাশি ব্যয় সাশ্রয় না হওয়ায় এই অনাগ্রহের কারণ। পানগাঁও টার্মিনাল ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে ট্যারিফ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং কন্টেনার জাহাজীকরণে দীর্ঘসূত্রতা কমানোর পাশাপাশি কিছু প্রণোদনা থাকা উচিত বলে মনে করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ কমাতে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে তোলা হয় পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। অনেক আশা ছিল এ টার্মিনাল নিয়ে। ধারণা করা হয়েছিল কম খরচের জন্য ব্যবসায়ীরা নদীপথে তাদের আমদানি-রফতানির কন্টেনার পরিবহন করবেন। কিন্তু চালু হওয়ার প্রায় আট বছরেও সেই টার্মিনাল তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। সক্ষমতার দশ শতাংশও ব্যবহৃত হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা এখনও তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক পথকেই সুবিধাজনক মনে করছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, আমদানি-রফতানিকারকরা যেন নদীপথে কন্টেনার পরিবহনে আগ্রহী হন সেজন্য এক্ষেত্রে ট্যারিফ ৭০ ভাগ কমানো হয়েছে। তারপরও আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হতে পারে জলপথে সময় বেশি লাগা। কমলাপুর আইসিডিতে আরও কম সময়ে এবং কম খরচে কন্টেনার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকাটাও পানগাঁওয়ের প্রতি নিরুৎসাহিত হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় ট্যারিফ ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন আনার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যারিফ ৭০ ভাগ কমানোর পরও পানগাঁও টার্মিনাল ব্যবহারে ব্যয় বেশি পড়ে। বিদেশ থেকে আসা কন্টেনারগুলো বড় জাহাজ থেকে নামিয়ে ছোট জাহাজে তোলা এবং সেখান থেকে নদীপথে পানগাঁও পর্যন্ত নিয়ে আসা কয়েকদিনের বিষয়। কিন্তু সড়কপথে দিনে দিনেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কন্টেনার নিয়ে আসা যায়। তাছাড়া ঘাটে ঘাটে ব্যয়ের ঝক্কি ও ঝামেলা রয়েছে নদীপথে কন্টেনার পরিবহনে। এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে তুলে পানগাঁওয়ে আনার পর সেখান থেকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে আবারও ট্রাক-কাভার্ডভ্যান বা লরি ভাড়া করতে হয়। কয়েক ভাঙ্গা দিয়ে কন্টেনার পরিবহনে ব্যয় তো কমছেই না বরং বাড়ছে। পানগাঁও ব্যবহারে একটি চল্লিশ ফুট কন্টেনার পরিবহনে ব্যয় হয় ১০ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু কমলাপুর আইসিডিতে খরচ সাড়ে ৪ হাজার টাকার মতো। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও অভিমুখে নিয়মিত জাহাজ থাকে না। ফলে আমদানির পণ্য কবে নাগাদ এসে পৌঁছাবে তা নিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল ব্যবহারে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কথা স্বীকার করে বলেন, এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। কারণগুলোর মধ্যে আছে সময় বেশি লাগা, পানগাঁও থেকে ঢাকার দিকে কন্টেনার পরিবহনে টোলপ্লাজা এবং কিছু বাড়তি ব্যয়। কীভাবে আগ্রহী করা যায় এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমদানি-রফতানিকারকদের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি। সে অনুযায়ী যদি বিদ্যমান ট্যারিফ ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে তা বিবেচনায় রয়েছে। পাশাপাশি তিনি এও বলেন যে, পানগাঁও টার্মিনালের পরিকল্পনা যখন করা হয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছিল সরু ও দুই লেনের। এখন তা চার লেনে উন্নীত হওয়ায় যানজটে সময় নষ্ট হওয়ার মতো সেই পরিস্থিতি আর নেই। তবে পানগাঁও মূলত করা হয়েছিল আমাদের নদীপথ ব্যবহারের জন্য। পণ্য পরিবহনে বিশ^ব্যাপী নদীপথই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। নদীপথ সড়কের তুলনায় পরিবেশবান্ধবও। সড়ক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে জলপথে কিছু প্রণোদনা দেয়া যায় কিনা সেটিও ভাবা যেতে পারে।

নদীপথে নিয়মিত জাহাজ না থাকা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক বলেন, এরসঙ্গে ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহের বিষয়টিও রয়েছে। নদীপথে নিয়মিত পণ্য পরিবাহিত হলে নিয়মিত জাহাজও থাকত। কমসংখ্যক আমদানিকারকই তাদের কন্টেনার পানগাঁওয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। যে পরিমাণ কন্টেনার পাওয়া যায় তা দিয়ে প্রতিদিনই জাহাজ চালানো সম্ভব হয় না। একটি জাহাজের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক কন্টেনার জমা হতে হয়। ফলে সপ্তাহের প্রতিদিন নির্দিষ্ট সিডিউলে জাহাজ চালাতে আগ্রহ পাচ্ছেন না এই রুটের জাহাজ পরিচালকরা। তাছাড়া ঢাকার দিক থেকে সমপরিমাণ রফতানির কন্টেনার থাকাও প্রয়োজন।

পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনালের বার্ষিক কন্টেনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১ লাখ ১৬ হাজার টিইইউএস। কিন্তু বছরে গড়ে হ্যান্ডলিং হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ হাজার কন্টেনার। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার টেক্সটাইল খাতের ৪০ শতাংশ কন্টেনার নদীপথে পরিবহনের পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয় এই কন্টেনার টার্মিনাল। কিন্তু সেই কর্মব্যস্ততা নেই, যেমনটি আশা করা হয়েছিল। ওই রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন সাইজের জাহাজগুলোর কন্টেনার ধারণক্ষমতা ১২০ থেকে ১৮০। যতগুলো জাহাজ চলার কথা ততগুলো চলছে না ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না হওয়ার কারণে। পণ্য প্রবাহ কম থাকায় পর্যাপ্তসংখ্যক সিএ্যান্ডএফ এজেন্টও নেই। তবে সেখান থেকে সাভারের হেমায়েতপুর পর্যন্ত সড়কের কাজ সম্পন্ন হলে পানগাঁওয়ের ব্যস্ততা বাড়বে বলে আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
Leave a Reply