করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে সংকট চলছে। আমরাও এর ভুক্তভোগী। শুরুতে রপ্তানি পণ্য নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। রপ্তানি পণ্যের জট এখনও কমেনি। এরই মধ্যে বন্দরে আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার জমতে শুরু করেছে। কারণ লকডাউনে খাদ্যপণ্য, ওষুধ ছাড়া সব শিল্পকারখানা বন্ধ। কারখানা বন্ধ থাকায় আমদানিকারকরা কনটেইনার খালাস করতে পারছে না। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে লজিস্টিকস সেবা ঠিক রাখতে হবে। লজিস্টিকস ঠিক রাখতে বন্দর এবং বন্দরের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করে তোলা দরকার।
বন্দরে জট কমাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন ব্যবসায়ী সংগঠনকে চিঠি দিয়েছে পণ্য খালাসের জন্য। তবে চলমান লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকলে খালাস নেওয়ার হার বাড়বে না। এখন চাইলে সহজে পণ্য খালাসের জন্য গাড়িও মিলছে না। ফলে জট কমবে না। এ পরিস্থিতিতে বন্দরের অনুরোধে এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে এনবিআর বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া সব পণ্য ডিপোতে স্থানান্তরের অনুমোদন দিয়েছে। হয়তো এটা সাময়িক সমাধান হতে পারে। তবে লকডাউন যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে এই সাময়িক সমাধানও খুব বেশিদিন কাজে আসবে না।
এবার বন্দরের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকানো যাক। চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউএস কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা আছে। রোববার সকালে ছিল ৪৩ হাজার ৫৭৪ টিইইউএস কনটেইনার। ধারণক্ষমতা যত কমে আসবে ততই কনটেইনারের অপারেশনাল কার্যক্রম স্থবির হয়ে আসবে। ২৪ ঘণ্টায় কনটেইনার ডিপোতে স্থানান্তর হয়েছে এক হাজার সাত টিইইউএস। আমদানিকারকরা খালাস নিয়েছে ৮৯৪ টিইইউএস। এ সময় জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার বন্দরে নেমেছে ৪২৪৩ টিইইউএস। বন্দরের জেটিতে কনটেইনারবাহী জাহাজ ছিল ১০টি, সাগরে অপেক্ষায় ছিল ১৫টি। এই চিত্রই বলে দেয়, বন্দরে ফাঁকা জায়গা দ্রুত কমে আসছে।
চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৭৮ হাজার ৭০০ টিইইউএস। বর্তমানে আছে ৫৪ হাজার টিইইউএস কনটেইনার। তাহলে সেখানে বড় জোর ১৫-২০ হাজার কনটেইনার স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। এর বেশি নেওয়া হলে ডিপো থেকে পণ্য খালাসে বেশি সময় লাগবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি দুটোই বাড়ছে। কিন্তু আমাদের অবকাঠামো সে হারে বাড়ছে না। সে জন্যই সংকটের সময় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জট নিরসনে সাময়িকভাবে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে কনটেইনার স্থানান্তর করা হলে আমদানিকারকদের সময় বেশি লাগবে, খরচ বাড়বে। লকডাউন খোলার পর তখন পণ্য খালাসের সরবরাহ চেইনে ভয়াবহ চাপ তৈরি হবে। আবার ডিপোগুলো এমনিতেই রপ্তানি পণ্য নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক ডিপোতে এখন রপ্তানি পণ্য গাড়ি থেকে নামিয়ে রাখার জায়গা নেই। সেখানে আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার নিয়ে খালাস করতে গেলে বেগ পেতে হবে। যদিও ডিপোতে সরিয়ে নেওয়ার মতো বড় বিকল্প বন্দরের হাতে ছিল না। মনে রাখতে হবে, বন্দরের মতো আধুনিক এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিকস ডিপোগুলোর নেই।
কারখানা খোলা ছাড়াও অনেক পণ্য আছে, যেগুলো গুদামে নেওয়া হয়। সেসব পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দর থেকে যাতে খালাস করা যায় সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে সংশ্নিষ্ট বিভাগ। এ উদ্যোগ বন্দরকেই নেওয়া দরকার। তাহলে ডিপোর পাশাপাশি আমদানিকারকরাও পণ্য নিতে পারবেন। আবার সরকার আমদানিকারকদের সুযোগ দিতে পারে, যাদের জরুরি পণ্য আছে তারা বিশেষ ব্যবস্থায় কারখানার গুদাম বা চত্বর খোলা রেখে পণ্য নিয়ে রাখতে পারে। এ মুহূর্তে এসব ছোট ছোট উদ্যোগ কাজে লাগতে পারে। আবার পানগাঁও নৌ টার্মিনালে তুলার কনটেইনার যাতে নেওয়ার হার বাড়ে, সে জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার। এটা করা হলেও বন্দরের ওপর চাপ কমবে।
করোনা শিগগিরই যাবে না। সামনে এমন সংকট তৈরি হবে, ধরে নিয়ে এখনই বন্দরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা বহু আগেই বলে আসছি বন্দরের ভেতর থেকে এলসিএল কনটেইনার ব্যবস্থাপনা সরিয়ে নিতে। এটা করা হলেও বন্দরের ওপর চাপ কমবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সহজ শর্তে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের বন্ডেড ওয়্যার হাউসের অনুমতি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। বন্দর যদি ফরোয়ার্ডারদের ওয়্যার হাউস করার জন্য জায়গা বরাদ্দ দেয় তাহলে সেই জায়গায় ডিস্ট্রিবিউশন পার্ক তৈরি করে ওয়ানস্টপ সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এটা বন্দরের কাজ কমিয়ে দিতে পারে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বে টার্মিনালের জন্য বরাদ্দকৃত কিছু জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে ইয়ার্ড নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, যাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার সেই ইয়ার্ডে নিয়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে এখন এ সংকট সহজেই মোকাবিলা করা যেত। ইয়ার্ড এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে পরবর্তীকালে বে টার্মিনাল নির্মাণের মধ্যে ইয়ার্ডকে সংযুক্ত করা যায়।
আমাদের বন্দর অবকাঠামো খুবই সীমিত। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যেভাবে বাড়ছে, বন্দর অবকাঠামো সেভাবে বাড়েনি। ফলে এখন সংকটের সময় সরবরাহ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে নতুন বন্দর দরকার। সরকার অনেক প্রকল্প হাতে নিলেও বে টার্মিনালকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
চলমান সংকটের সমাধান করতে হলে স্বল্পমেয়াদের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রেখে বন্দরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।
লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফা); পরিচালক, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন
mta.suzan@gmail.com
Leave a Reply