আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাংলাদেশী লাল-সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। করোনাকালে বিশ্বজুড়ে জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায় এখন দুঃসময়। আন্তর্জাতিক অনেক শিপিং কোম্পানিই নিজেদের বহরে থাকা ভাড়ায় চালিত জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে। এদিকে সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পের জন্য চলতি অর্থবাজেটে সরকারের দেওয়া বেশকিছু সুবিধা যোগ হয়েছে। এসব কারণে দেশের বহরে যুক্ত হচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ। তাতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাড়ছে লাল–সবুজের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা। চলতি বছর আট মাসে ১০টি জাহাজ নতুন রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৭২টিতে। ২০২০ সালে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে ১৪টি জাহাজ। করোনাকালে গত দেড় বছরে নতুন করে ২৪টি জাহাজ বাংলাদেশী পতাকাবাহী রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আন্তর্জাতিক জাহাজ বহরে যোগ দিচ্ছে।
দেশের বহরে যুক্ত হওয়া জাহাজের সিংহভাগই সাধারণ পণ্য পরিবহনকারী মধ্যম আকারের বা ‘সুপরাম্যাক্স’ জাহাজ। সামান্য সংখ্যক তেল পরিবহনকারী জাহাজ (ট্যাংকার) ও কনটেইনার পরিবহনকারী ফিডার ভেসেল বা মাঝারি আকারের জাহাজ রয়েছে। বিদেশ থেকে ১৫–২০ বছরের পুরোনো জাহাজ আমদানি করে পণ্য পরিবহনে যুক্ত করেন উদ্যোক্তারা। প্রায় ৫০–৬০ হাজার টন পণ্য পরিবহন ক্ষমতার ‘সুপরাম্যাক্স’ আকারের একেকটি জাহাজের দাম পড়ে বয়সভেদে ১২০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ বাড়ছে কেন?
এ খাতের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় সরকারের শুল্ককর সুবিধাসহ নীতিসহায়তাও এখন আগের তুলনায় বেশি। দেশে নিবন্ধিত জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষা করে গত বছর নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আবার করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে জাহাজের দাম বেশ কমে গেছে। এই দুই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা এ সময়ে এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। পণ্য পরিবহনে ভাড়া কমে গেলেও সংকট কেটে গেলে যাতে সুযোগ নেওয়া যায় সে জন্য এই সংকটের সময়কে বিনিয়োগের সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, সেবাশিল্প হিসেবে এই খাতে সরকারের নীতিসহায়তা আগের চেয়ে বেশি। এতে করোনার সময় জাহাজ নিবন্ধন বেড়েছে। তবে কেনার পর পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি করা যাবে না এমন অঙ্গীকার তুলে দেওয়াসহ আরও কিছু নীতিসহায়তা দেওয়া হলে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। তিনি মনে করেন, এই খাতে বিনিয়োগ হলে দেশীয় নাবিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়বে। আবার নিজেদের পণ্য পরিবহন করেও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে।
এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো শুরুতে নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ পরিচালনা ব্যবসা শুরু করে। বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের পণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজেও বিনিয়োগ বাড়ছে। নিজেদের পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এ দেশের জাহাজমালিকেরা। যেমন কেএসআরএমের মতো গ্রুপ সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নিজেদের বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।
জাহাজের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে এক বছরে সরকার অনেক সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। বড় জাহাজ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশীয় জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার রয়েছে। গত বছর দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন।
দেশে এখন পণ্যবাহী সমুদ্রগামী সবচেয়ে বেশি জাহাজ রয়েছে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির বহরে জাহাজের সংখ্যা ২৩টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৫ সালে এই বৈশ্বিক ব্যবসায় নেমে গ্রুপটি এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে। কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সুবিধা বেড়েছে। আবার বিশ্ববাজারে সমুদ্রগামী পুরোনো জাহাজের দর এখন ক্রেতার পক্ষে। বিনিয়োগ বাড়ার কারণ এটি।
দেশে এক দশক ধরে লাল–সবুজের পতাকাবাহী কোনো সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ছিল না। দুটি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে কনটেইনার জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা শুরু হলেও এক দশক আগে সরে যায় তারা। এই খরা কাটিয়ে করোনার সময় ১১৬ কোটি টাকায় দুটি কনটেইনার জাহাজ কিনে এই খাতে ব্যবসা শুরু করেছে কর্ণফুলী লিমিটেড। জাহাজ দুটি এখন চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং পথে কনটেইনার পরিবহন করছে। প্রতিটি জাহাজ ১ হাজার ৫৫০ একক কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম। সর্বশেষ চলতি বছর আরও চারটি কন্টেইনার জাহাজ নিজেদের বহরে যুক্ত করেছে কর্ণফুলী গ্রুপ। তাদের জাহাজের সংখ্যা এখন আটটি।
কেএসআরএম গ্রুুপের পর সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে (বাল্ক ভেসেল) দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে মেঘনা গ্রুপ। তাদের রয়েছে ১১টি জাহাজ। আকিজ গ্রুপের রয়েছে ১০টি জাহাজ। এছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের আটটি, বসুন্ধরা গ্রুপের চারটি, এমআই সিমেন্টের তিনটি জাহাজ রয়েছে। ওরিয়ন গ্রুপেরও রয়েছে একটি জাহাজ।
বাংলাদেশে তিন দশক আগে সরকারি খাত এগিয়ে থাকলেও এখন বেসরকারি খাতই এই সেবাশিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারি খাতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ১৯৭২ সালের জুনে ‘এমভি বাংলার দূত’ জাহাজে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ব্যবসার যাত্রা শুরু করে। ১৯৮২ সালের মধ্যে ২৭টি জাহাজ যোগ হয় এই সংস্থার বহরে। পর্যায়ক্রমে এই সংখ্যা ৩৮টিতে উন্নীত হয়। তবে ১৯৯১ সালের পর এই সংস্থার বহরে নতুন কোনো জাহাজ যুক্ত হয়নি। উল্টো জাহাজের সংখ্যা কমে একপর্যায়ে দুটিতে নেমে আসে। এরপর সংস্থাটি গত দেড় বছরের মধ্যে ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকায় ছয়টি নতুন জাহাজ সংগ্রহ করেছে।
সরকারি খাতের চেয়ে এই সেবাশিল্পে বেসরকারি খাতের বয়স কম। তা–ও ৪৩ বছর। ১৯৭৮ সালে প্রায় ১০ হাজার টন ধারণক্ষমতার ‘এমভি আল সালমা’ জাহাজ নিবন্ধনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে এই ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। অ্যাটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সানাউল্লাহ চৌধুরী বেসরকারি খাতে এই শিল্পের পথিকৃৎ। তবে দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা শিল্প থেকে সরে আসে। এই উদ্যোক্তার দেখানো পথ ধরে এখন যুক্ত হচ্ছে বড় বড় শিল্পগ্রুপ।
নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় বহরে সবচেয়ে বেশি জাহাজ ছিল ২০১২ সালের জুন মাসে। সে সময় নিবন্ধিত জাহাজের তালিকায় ছিল ৬৮টি। তবে এই সংখ্যা বেশি দিন থাকেনি। জাহাজ ব্যবসায় মন্দার কারণে পরের দুই বছরে তা ৪০টিতে নেমে আসে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এই সংখ্যা বাড়তে শুরু করে আবার। করোনাকালে কার্যত চাঙা হয়ে উঠছে দেশীয় সমুদ্রগামী জাহাজ বানিজ্য। কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি- চারটি অর্জনও যোগ হচ্ছে এই একটি খাত থেকেই।
Leave a Reply