সাম্প্রতিককালের মোটর ইন্স্যুরেন্স নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে সংশ্নিষ্ট সবাই যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে ইন্স্যুরেন্স সেক্টরে আশার আলো দেখা দিয়েছে। তাই এই ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেননা ২০১৮ সালে মোটর ইন্স্যুরেন্স থার্ড পার্টি বাতিল সংক্রান্ত যে আইনটি পাস হলো এবং এর আগে যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল সে বিষয়ে বীমা-সংশ্নিষ্টদের আলাপ-আলোচনা বা বাদ-প্রতিবাদ তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না বা এ বিষয়ে খুব একটা দেনদরবার হয়েছে বীমা-সংশ্নিষ্টদের কর্তৃক, তারও জুতসই প্রমাণ নেই। ফলে আইনটি পাস আর পরবর্তী সময়ে প্রয়োগ যখন শুরু হলো আর ইন্স্যুরেন্স মার্কেটে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ল, তখনই বীমা-সংশ্নিষ্টদের টনক নড়ে উঠল। বিশেষ করে যখন বিআরটিএ ঘোষণা দিল, গাড়ির মালিককে ইন্স্যুরেন্স করা বাধ্যতামূলক নয়। সরকার মোটর বীমার আয় থেকে উপার্জিত ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং হবে যদি না মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক না করলে কেউ করতে চায় না। তাই কর্তৃপক্ষ দেশকে সভ্যতার মানদণ্ডে নেওয়ার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্সকে বাধ্যতামূলক করতে বাধ্য হয়। তেমনি বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল অর্থাৎ এই উপমহাদেশের দেশগুলো ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মোটর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক, অন্তত মোটর থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালানো যাবে না। সভ্য সমাজের অনেক মানদণ্ডের একটি ও প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে দায়বদ্ধতা নিজের এবং অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। যে দেশের জনগণ ও সমাজের দায়বদ্ধতা বেশি, সেই দেশ তত সুসভ্য। আর এই দায়বদ্ধতা পালনকে সহজীকরণে লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সের উদ্ভব হয়েছে আধুনিক অর্থনীতি চালনায়। তাই প্রথমে আমাদের এই মর্মে একমত হতে হবে যে নিজেকে সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে দাবিদার হতে হলে, রাস্তায় গাড়ি চালাতে হলে আমরা আমাদের দায়বদ্ধতা এড়াতে পারি না, বিশেষ করে গাড়ি চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ আর তৃতীয়পক্ষের সম্পদের হেফাজতকে মাথায় রেখে গাড়ি চালাতে হবে। তাই গাড়ির যে কোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বা সম্পদের ক্ষতিপূরণ গাড়ির মালিককে বহন করতে হবে। আর গাড়ির মালিক এই ক্ষতি আধুনিক অর্থনীতির মেকানিজম ইন্স্যুরেন্স দ্বারা পূরণ করবেন। সেই কারণে রাস্তায় গাড়ি নামাতে বা চালাতে হলে মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এখন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মোটর কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্স করতে না পারলেও অন্তত মোটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক করাকে আবার পুনঃসংযোজন করা উচিত বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকার বা অন্য কোনো অথরিটি কাউকে তার সম্পত্তির নিজস্ব ক্ষতির বীমা নিতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে না (কিছু চুক্তিতে সম্পত্তি ইন্স্যুরেন্সে নেওয়ার শর্ত থাকে, তার ভিন্ন উদ্দেশ্য। এটা করা হয় যাতে কোনো দুর্ঘটনায় সম্পত্তির ক্ষতি হলে তা দ্রুত রিইন্সটেড করা যায় আর তাতে চুক্তির কাজ সম্পাদনে সময়ক্ষেপণ না হয়)। ইচ্ছে হলে যানবাহন বা সম্পত্তির বীমা নেবে, ইচ্ছে না হলে নেবে না। একজন বিলিয়নেয়ার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা কিনবেন। তার বাড়ি পুড়ে গেলে আরেকটা বানাবেন। সরকার বা অন্য কেউ বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু আমাকে থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সে নিতে বাধ্য করতে পারে সরকার বা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কারণ তাতে জনস্বার্থ সংশ্নিষ্ট আছে। বলা যায়, থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স নেওয়া অপশনাল নয়। অপশনাল করতে হলে যাত্রীর জান আর মালের সঙ্গে অন্য থার্ড পার্টি ও তাদের সম্পত্তি উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে উপধারা-২ পরিস্কার করতে হবে- যথাযথ নিয়ম বলতে কোন নিয়মকে বলা হয়েছে। কম্প্র্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্সে বাধ্যতামূলক নিয়ম পাল্টাতে হবে। খুব সহজভাবে যদি আমরা সরলীকরণ করি তাহলে বলতে হয় : মোটর বীমা বাধ্যতামূলক করা; কম্প্রিহেনসিভ মোটর বীমা যদি বাধ্যতামূলক করা হয় তবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় রেখে প্রিমিয়াম, কমপেনসেশন ও অন্যান্য বিষয় সামনে এনে তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি রুলস অব বিজনেসের নির্দেশনা দিতে হবে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে; রাস্তায় যানবাহন পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় নানাবিধ দুর্ঘটনায় পতিত হতে হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবহার্য গাড়ি দ্বারা অন্যের ক্ষতি সংঘটন এবং ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া প্রায় সব দেশেই রয়েছে। আর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে বীমা।
এ কে এম মনিরুল হক : চেয়ারম্যান, নিটল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
Leave a Reply