সারা দেশে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। গত তিন বছরে ৪ হাজার ৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ জন। এর মধ্যে বিদায়ী বছর ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। আগের বছর ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৮১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬৩ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ৯৪৫ জন। পরের বছর ২০২০ সালে এ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৬৩ জনে; যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে ১৩৮১টি।
সবশেষ ২০২১ সালে ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জন। সব মিলিয়ে গত তিন বছরে ৪৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪৬২২ জনের। ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর এ মৃত্যুর হার ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে। গত শনিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংগঠন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হামিদুজ্জামান, রোড সেফটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী প্রমুখ।
সংগঠনটির তথ্য মতে, সদ্য বিদায়ী ২০২১ সা?লে দেশে পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয় হাজার ২৮৪ জন মারা গেছেন, আহত ৭ হাজার ৪৬৮ জন। এর মধ্যে ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এসময় ১ হাজার ৫২৩ জন পথচারীসহ ৭৯৮ জন, নিহতদের মধ্যে নারী ৯২৭, শিশু ৭৩৪ এবং যানবাহন চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন। ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং টেলিভিশন চ্যানেলের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলে জানায় সংগঠনটি।
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬.১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪.৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০.৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১.৩৩ শতাংশ। এছাড়া সব শেষ বছর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০৭৮টি, নিহত হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জন , আহত ১ হাজার ৩০৯ জন। নিহতের মধ্যে ৭৪.৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১৪টি (৩৮.৪৯ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৬৭০ টি (৩১.০৯ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে ৯৫৪টি (১৭.৭৬ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৬৬৫টি (১২.৩৮ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬৮টি (১.২৬ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাগুলো ১০৫৭টি (১৯.৬৭ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮১৩টি (৩৩.৭৫ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৫৬৬টি (২৯.১৫ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৮২২টি (১৫.৩০ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১৩টি (২.১০ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
সংগঠনটি জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ। আবার ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫.৭০ শতাংশ আহত বেড়েছে ১.২০ শতাংশ। তবে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ এ তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। মূলত ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০ এবং ২০২১ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বেড়েছে।
মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোরও যুবক। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ার কারণও উল্লেখ করেছে সংগঠনটি। এর মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় শিকার হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুত গতির যানবাহনের চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর ফলে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জাপান নিজের দেশে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ আমাদের দেশকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বানিয়েছে। বিশ্বের সব দেশ এখন মোটরসাইকেল কমিয়ে আনছে। আমাদের দেশেও মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও বেশকিছু সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এরমধ্যে রয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি। সংগঠনটি বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। এরমধ্যে রয়েছে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে, বিআরটিএ্থর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে হবে, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
Leave a Reply