গাইবান্ধার বালাসী ঘাট উত্তরাঞ্চলের মানুষের একসময়ের স্বাচ্ছন্দ্যের যোগাযোগমাধ্যম হলেও এখন সেখানে শুধু ঘাট আছে, নদী নেই। নদীর বুকে এখন ধু-ধু বালুচর। সেখানে দিগন্তবিস্তৃত মাথা সমান উঁচু ভুট্টার খেত পৌষের বাতাসে দোল খায়। ঘাট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শীর্ণ নদীতে ছোট নৌকায় যাত্রী পারাপার হয় দুপাড়ে দড়ি বেঁধে।
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন শুধু বর্ষায় পানির দেখা মেলে। বাকি সময় ঘাট থেকে নদীর গতিধারা বহু দূরের পথ। বালাসী ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ফেরি রুট নাব্য সংকট ও যমুনা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে ২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও নতুন করে ফেরি চালু করতে দুই দফায় ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করে নৌ-টার্মিনালসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়।
এই নৌ-টার্মিনাল ও অবকাঠামো এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পানিশূন্য নদীতীরের মূল্যবান অবকাঠামো ঘিরে সেই বালাসী ফেরিঘাট আর চালুর কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না স্থানীয়রা। বালাসী ঘাট গাইবান্ধা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে ফুলছড়ি উপজেলায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত বিখ্যাত নৌবন্দর। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাটে রেলফেরি সার্ভিস চালু করা হয়।
পুরো একটি ট্রেন নদী পার হতো বিশ্বের অন্যতম এই রেল ফেরিতে। প্রায় ৮৪ বছরের পুরনো সেই জমজমাট নৌবন্দর এখন খাঁ খাঁ করছে। ঘাটকেন্দ্রিক দুই পাশের মানুষের জীবিকা সংকট চরমে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য একসময় ময়মনসিংহ, সিলেট, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রেলযোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট। কিন্তু নাব্য সংকট ও যমুনা নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ায় এই ফেরিঘাট গুরুত্ব হারায়।
অন্যদিকে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন বন্ধ হয়ে যায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে অতিরিক্ত যানবাহনের চলাচলের চাপ লাঘবের জন্য সেতুটির ধারণক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় বিকল্প পথ তৈরির যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালে বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে একনেকে বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌ-রুটটি আবারও চালু করতে ফেরিঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, গেস্ট হাউস ও আনসার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এসব অবকাঠামো নির্মাণের পর বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্য সংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌ-রুটটি নৌযান চলাচলের অনুপযোগী বলে মন্তব্য করে। প্রায় দেড় শ কোটি টাকা খরচের পরও বালাসী ঘাট চালু হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নৌ-টার্মিনাল ও নতুন অবকাঠামো এখন জনমানবহীন প্রান্তর হয়ে আছে। গত বছরের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। এরপরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে জানানো হয়, নাব্য সংকটের কারণে এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ এবং শেষ পর্যায়ে এসে ফেরিঘাট প্রকল্প বাতিলের এমন সিদ্ধান্তে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ফেরিঘাট নিয়ে উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন হতাশাগ্রস্ত। সর্বশেষ গত বছরের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এই প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে সরেজমিন বালাসী ও বাহাদুরাবাদ ঘাট পরিদর্শন করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনেও বলা হয়, নাব্য সংকটের কারণে গাইবান্ধার বালাসী ঘাট থেকে ফেরি চলাচল সম্ভব নয়। উৎস : বাংলাদেশ প্রতিদিন।
Leave a Reply