বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেশে-বিদেশে পর্যটনের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের পর্যটন খাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প একটি ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন খাত। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বর্ষা ও শীতকালে নদীতে ভ্রমণ এবং নদীর মাছের স্বাদ নেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। এ ছাড়া পর্যটন খাত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পর্যটন খাতে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন রিসোর্ট ও হোটেল পরিচালনার পাশাপাশি পর্যটন খাতে যারা জড়িত হতে চায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সরকার পর্যটনের উন্নয়ন এবং ক্রমবর্ধমান পর্যটন শিল্পকে পথ দেখানোর জন্য জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইনও একই কারণে প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০ দেশের অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে ইকো ট্যুরিজমকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু এই নীতিমালায় দুর্ভাগ্যজনক হলেও কৃষি-পর্যটনের কোনো গুরুত্ব নেই বলে দেখা যাচ্ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে উন্নয়ন ভাবনায়। কেননা, গ্রামের মানুষ প্রতিনিয়ত শহরমুখী হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভালো নয়। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদের মানুষ। কৃষি পর্যটন হলো পর্যটনের একটি উপখাত। শহর ও গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি বিবেচনা করে এ খাতে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী হলেও এখানে পারিশ্রমিক ও সম্মান কম। ফলে কৃষিভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন অঞ্চলকে অবশ্যই মূলধারার পর্যটন খাতের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন এবং এসব স্থান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত। নীতিমালা প্রণয়নের সুবিধার্থে এবং পর্যটন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতি কাঠামোতে কৃষি পর্যটন স্বীকৃত। জাতীয় কৃষি নীতিমালা ২০১৮ এবং জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ২০২০ কৃষি পর্যটনকে উন্নত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনার কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে।
গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলায় গোপালগঞ্জ অববাহিকায় প্লাবনভূমিতে ভাসমান বাগানে কৃষি পর্যটন প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। ভাসমান বাগান ইউএন এফএও দ্বারা ২০১৬ সালে গ্লোবালি ইমপর্টেন্ট এগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেমস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গ্রামের নারীরা বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ সামগ্রী ও লোকালয়ে পাওয়া যায় এ রকম উপাদান ব্যবহার করে বাগানের কাঠামো তৈরি করে। এ ছাড়া বীজ প্রক্রিয়াকরণ ও রোপণ খুবই আকর্ষণীয়। পানিতে শাকসবজি, ফল চাষ এবং সংগ্রহ করা কেবল দেখতেই সুন্দর নয়; এখানে উৎপাদিত খাবারও মানুষের মাঝে বেশ আকর্ষণ তৈরি করে। ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করা যেতে পারে, যেখানে পর্যটকরা নৌকায় ভ্রমণের পাশাপাশি অর্গানিক শাকসবজি ও ফলের স্বাদ পাবেন। সিলেটের জলাভূমি- রাতারগুল, খুলনার সুন্দরবন, পাহাড়ি কৃষি, হাওর অববাহিকায় মাছ ধরা, গদখালীর ফুল চাষ, চা বাগান, দেশের বিভিন্ন এলাকায় হলুদে ভরপুর সরিষা জমিতে মৌ চাষ, বরিশালের উপকূলীয় প্লাবনভূমিতে ভাসমান দেশি পেয়ারার বাজার সম্ভাব্য কৃষি পর্যটনের ভালো কিছু উদাহরণ। এ ছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে জুম চাষ এবং গ্রামীণ নারীদের বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত ফসলও জৈব চাষ হিসেবে স্বীকৃত, যার পুষ্টিমান অনেক বেশি।
কৃষি পর্যটন একটি পুরোনো অনানুষ্ঠানিক পর্যটন খাত হলেও এটি পর্যটন শিল্প হিসেবে কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। বিনোদন ও শিক্ষণের জন্য কৃষি পর্যটনের উন্নয়নে বাড়তি মনোযোগ প্রয়োজন। সর্বপ্রথম কাজ হলো কৃষির সঙ্গে জড়িত বিভাগ, স্থানীয় সরকারি সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কৃষিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণগুলোকে চিহ্নিত করা। এ ছাড়া বিভিন্ন মেয়াদের ট্যুর সংগঠিত করার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতাসহ ট্যুর পরিচালনার জন্য সুপ্রশিক্ষিত, দক্ষ, পেশাদার জনবল তৈরি করতে হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা, খাদ্য, বাসস্থানসহ স্থানীয় রসদ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে কৃষি পর্যটন প্রচারের জন্য সর্বোত্তম উপায় হলো সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে অংশীদারিত্ব তৈরি করা। কৃষি (মৎস্যসহ), পর্যটন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, নৌপরিবহন এবং বেসরকারি অপারেটরদের খাদ্য ও বাসস্থানের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়গুলোকে কৃষি পর্যটনের প্রচারের জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কৃষি বিভাগ পর্যটন স্পট চিহ্নিত, সচেতনতা তৈরি করতে পর্যাপ্ত রসদ এবং দক্ষতা সরবরাহে ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ে কৃষি পর্যটনের জন্য একটি পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ে কৃষি ছাত্রদের ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন কৃষিশিক্ষার ভিত্তি রচনা করে ভবিষ্যৎ কৃষি স্নাতকদের দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং দেশসেবায় কাজে লাগাতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত পর্যটন খাতের জন্য সুপরিচিত এবং দেশটিতে কৃষি পর্যটনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য সরকার রাজ্যে কৃষি পর্যটন বিকাশে সহায়তা প্রদান করে। শ্রীলঙ্কা ১৯৯৫ সালে কৃষি পর্যটনের সূচনা করেছিল। সেখানে বর্তমানে ১০টি জেলায় বিভিন্ন স্কেলে ১৫টি কৃষি পর্যটন কার্যক্রম চলছে। কিন্তু আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কৃষি পর্যটনের বিষয়টি অবহেলিত। কৃষিতে পর্যটন যোগ করা হলে কৃষক এবং গ্রামীণ এলাকার জন্য বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব, যা গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবিকা নির্বাহে অবদান রাখতে পারে।
ড. সুস্মিতা দাস: প্রিন্সিপাল ডকুমেন্টেশন অফিসার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
Leave a Reply