মোটরসাইকেল, হালকা, মাঝারি বা ভারী যান- যেকোনো ধরনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা সহজেই করে দিত লিটন পাইক। বিনিময়ে দিতে হত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। লাইসেন্সের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন ও ডোপ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল তার। সে ও তার সহযোগীরা রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে রীতিমতো এক ভুয়া বিআরটিএ অফিসই খুলে বসেছিল। আর এই চক্রে জড়িত খোদ বিআরটিএ’র কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। জালিয়াতির মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরিতে জড়িত একটি চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার এসব তথ্য জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি বলছে, গ্রেপ্তারকৃতরা মূলত বিআরটিএ অফিসের দালাল। তবে নিজেদের তারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিত।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- লিটন পাইক, সুজন পাইক, হাসান শেখ ওরফে আকচান, মোহাম্মদ আলী ওরফে মিস্টার, আব্দুল খালেক, আবদুল্লাহ রনি, সোহেল রানা, মোঃ সোহাগ, মোঃ নুরনবী ও হুমায়ুন কবির।

গত সোমবার থেকে ধারাবাহিক অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিম।
এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ফাইল, শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ফরম, ডোপ টেস্ট ফাইল, দু’টি মনিটর, দু’টি সিপিইউ, দুটি কিবোর্ড, একটি রঙিন প্রিন্টার, একটি লেমিলেটিং মেশিন, দু’টি ভিজিএ কেবল, দু’টি পাওয়ার কর্ড ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এতে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, দেশে বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে বেরিয়ে আসে চালকদের অদক্ষতা, অসাধু উপায়ে খুব সহজেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়গুলো। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে ডিবি। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে বিআরটিএ’র ভুয়া অফিস পরিচালনাকারী একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
সোমবার রাতে মিরপুর মাজার রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ফাইলসহ লিটন, সুজন ও হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে জব্দকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ফাইলে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখা হয়।

তাতে দেখা যায়, বিপি বা বাংলাদেশ পুলিশ নম্বরটি ভুয়া। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করে, বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আবেদন ফাইলগুলো অফিসের বাইরে আনা হয়। এরপর তারা জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট তৈরি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দেয়। তাদের তথ্যমতে মিরপুরে দিয়াবাড়ী বিআরটিএ অফিস ও এর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স করতে আসা ব্যক্তিরা লিটনের ভুয়া অফিসকে বিআরটিএ অফিস বলেই জানতেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে আবেদনকারীকে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ও ডোপ টেস্টের সনদ দিতে হয়। লিটনের নেতৃত্বে দালালেরা জাল সনদ তৈরি করে আবেদনপত্র দিয়াবাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়ে তাদের কমিশনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে জমা দিত।
ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ বলেন, বিআরটিএর কর্মকর্তারা জেনেশুনেই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ভুয়া কাগজপত্র জমা নিতেন। তারা দুই হাজার টাকা নিয়ে মাঠে যান চালানোর পরীক্ষায় একেকজনকে পাস করিয়ে দিতেন। এরপর এক মাসের মধ্যেই ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেওয়া হত।
জাল কাগজপত্র দিয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাঁচ শতাধিক মানুষকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে এই চক্র। এর সঙ্গে জড়িত বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান রাজীব।
Leave a Reply