‘বগুড়া থেকে চাল এনে তেজগাঁও নামিয়ে কাঁচপুরে যাচ্ছি গাড়িতে মাল তুলতে। হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে নামার পরই লাঠি উঁচু করে তিনজন ট্রাক থামাল। সিটি টোলের নামে তারা চাইল ১৩০ টাকা। বললাম, আজ রাতে খাওয়ার টাকাও কম। এত টাকা দিতে পারব না। এ কথা শুনে তারা বলে, টাকা না পেলে গাড়ি ছাড়বে না। পরে ৫০ টাকা দিলাম। টাকার রসিদ দেয়নি। বলেছে, ৫০ টাকায় রসিদ দেওয়া যাবে না।’ সম্প্রতি এক রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়ায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন ট্রাকচালক আসাদুল ইসলাম।
ওই রাতে হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামার পর কাজলার ‘মেসার্স ফাতেমা নাজ’ পেট্রোল পাম্পের সামনের সড়কে ট্রাকটি (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-৩২৯০) সিটি টোলের নামে লাঠিয়াল বাহিনীর চাঁদাবাজির মুখে পড়ে। শুধু এখানেই নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাভুক্ত বিভিন্ন সড়কে লাঠিয়াল বাহিনী এখনও সরব। সিটি টোলের নামে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থামিয়ে তাদের অবৈধ চাঁদাবাজি চলছেই। অজানা কারণে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব।
যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, কাজলা, রায়েরবাগ, জুরাইন, গুলিস্তান, টিকাটুলীসহ ডিএসসিসির আওতাভুক্ত বিভিন্ন এলাকার সড়কে সিটি টোলের নামে চলন্ত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থামিয়ে চাঁদাবাজি নিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর ‘ঢাকার রাস্তায় লাঠিয়াল’ শিরোনামে সমকালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান সিটি টোলের আওতার বাইরে, সেটি উল্লেখ করে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কেউ টোলের নামে এসব যান থেকে টাকা ওঠায় এটি অবৈধ। এ ছাড়া চলন্ত কোনো গাড়ি থামিয়ে টোলের টাকা ওঠানোর নিয়ম নেই। প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সংবাদ প্রকাশের পর কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে ফের শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি। চালক-হেলপার ও গাড়ির ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে আগের মতোই।
গত ১১ জানুয়ারি শনিরআখড়ায় সিটি টোলের নামে দাবি করা চাঁদা না দেওয়ায় ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট-১৮-৩৪৭২) চালককে মারধর এবং গাড়ি স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি থামানোর চেষ্টা চালায় লাঠিয়াল বাহিনী। চালক দুলালের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ট্রাকটি সামনের অপর একটি ট্রাকে ধাক্কা লাগলে চালক আহত হন।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের নেতারা পণ্যবাহী গাড়ি থেকে সিটি টোলের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে সংশ্নিষ্টদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করেও ফল পাচ্ছেন না। সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চাঁদাবাজির বিষয়ে জানিয়েছি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাস্তায় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি। তার পরও চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইজারার সুনির্দিষ্ট শর্তের বাইরে কোনো কাজ করলে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সম্প্রতি টিকাটুলী, গুলিস্তান কাপ্তারবাজারে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার পাশে, গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কাজলা ফাতেমা পাম্পের সামনের সড়ক এবং শনির আখড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, রাতে আগের মতোই চাঁদাবাজি চলছে। তবে কাপ্তানবাজারে সিটি টোলের পাশাপাশি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে পঙ্গু ও বেকার শ্রমিক কল্যাণের নামেও টাকা আদায় করা হচ্ছে। রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কাপ্তান বাজারে অবস্থান করে দেখা যায়, ফ্লাইওভার থেকে নামার পর গাড়িগুলো টোল দিয়ে বের হওয়া মাত্রই অবৈধ সিটি টোলের মুখে পড়তে হচ্ছে। তিনজনকে এই চাঁদা তুলতে দেখা যায়। সিটি টোল হিসেবে প্রতিটি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থেকে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ‘ঢাকা জেলা ট্রাক ট্যাঙ্কলরি কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের’ রসিদ দিয়ে পঙ্গু ও বেকার শ্রমিক কল্যাণের নামে ৫০ টাকা করে তুলছিল তারা।
পোস্তগোলা থেকে ট্রাকে (যশোর ট ১১-৫৪১০) পণ্য বোঝাই করে সাতক্ষীরায় যাচ্ছিলেন চালক আলমগীর হোসেন। গুলিস্তান মোড়ে সিগন্যালে গাড়ি থেমে থাকার সময় রাত ১১টা ৪০ মিনিটে তিনি বলেন, ‘টোল প্লাজা পার হওয়ার পর সিটি টোল ও শ্রমিক কল্যাণের জন্য ১০০ টাকা চাঁদা চায় ওরা। ৮০ টাকা দিয়েছি।’ প্রায় একই সময় কথা হয় আরেক ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট-১৮-৩৪০০) চালক রহিমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার কাছে ১১০ টাকা চাঁদা চাওয়া হয়েছিল। তিনি ১০০ টাকা দিয়ে পার পেয়েছেন। আরেক চালক জানালেন, তার কাছ থেকে সিটি টোল ও বেকার শ্রমিক কল্যাণে ১৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে।
কাপ্তান বাজারের এক মুরগি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি রাতেই তারা চাঁদাবাজির এই দৃশ্য দেখেন। চালকদের সঙ্গে চাঁদা আদায়কারীদের বাগ্বিতণ্ডা হয় প্রায়ই। টাকা দিতে রাজি না হলে মারধরও করা হয় চালক-হেলপারকে।
রাত ১১টা ১২ মিনিট থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফুলবাড়িয়া মোড়ে অবস্থান করে দেখা যায়, সাতজন সড়ক বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে। তাদের তিনজনের হাতে লাঠি। বাকি চারজনের হাতে লেজার লাইট। সড়কের দু’পাশে লেজার লাইট দিয়ে ট্রাক থামিয়ে সিটি টোলের নামে টাকা আদায় করছিল তারা। অনেক সময় দূর থেকে লেজার লাইটে গাড়ি না থামলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লাঠি দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য করা হয়।
টিকাটুলীতে হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে প্রতিদিন সাত ব্যক্তি সিটি টোলের নামে টাকা ওঠায়। রাত ১২টা ২০ মিনিট থেকে রাত ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করে তাদের চাঁদাবাজি করতে দেখা যায়। এর ১০০ গজ দূরে ওয়ারী থানা পুলিশের একটি টহল দল দাঁড়িয়েছিল। অবৈধভাবে রাস্তায় চাঁদা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে এক এএসআই বলেন, ‘যারা চাঁদা তুলছে তাদের বিষয়ে সবাই জানে। বড় অফিসাররাও এ রাস্তায় যাওয়ার সময় এসব দেখে। কেউ কিছুই বলে না। আমি কী বলব?’
Leave a Reply