বিনা টিকিটে ভ্রমণ, গত বৃহস্পতিবার রাতে রেলমন্ত্রীর তিন আত্মীয়কে জরিমানা; তারপরের ঘটনায় দেশ তোলপাড়, নানা মাধ্যমে চলেছে বহুমাত্রিক সমালোচনা। রেলমন্ত্রী পক্ষ থেকে ঘটনা নিয়ে এসেছে নানা বিবৃতি। তবে সমালোচনার মুখে পাল্টে গেছে ঘটনার মোড়, অবশেষে সত্যটা কী সেটাও মোটামুটি জানা গেছে। চাকরিও ফিরে পেয়েছেন ‘হঠাৎ’ বরখাস্ত টিটিই মো. শফিকুল ইসলাম। এবার সেই শফিকুল ইসলাম নিজেই জানালেন সেদিন খুলনা থেকে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে কী ঘটেছিল।
গতকাল রবিবার ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার জন্য বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়েছিলেন শফিকুল। পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
সেদিনের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালনের জন্য আমি স্টেশনে আসি। ১ নম্বর প্লাটফর্মে গাড়ি আসার পর আমাকে জানানো হয় এসিও (সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম) স্যারের অনুরোধক্রমে ৩ জন যাত্রী উঠেছেন, তারা এসি কেবিন যেটা ফাঁকা আছে সেখানে উঠেছেন। তখন আমি বললাম যে, তাহলে কি এসিও স্যারকে ফোন করে আমি জেনে নেব যে তারা কীভাবে যাবে? যেহেতু তারা বলেছে বিনা টিকিটের যাত্রী। আমি তখন এসিও স্যারকে ফোন দিলে তিনি বলেন, রেলমন্ত্রী মহোদয়ের আত্মীয় আছে তিনজন, ওরা এসি রুমের কেবিনে যাবে। আমি তখন বলেছি, স্যার আসলে তাদের তো কোনো টিকিট নাই, তাহলে কী করব? তখন এসিও স্যার বলেন, তাহলে তাদেরকে সাধারণ মানের যে টিকিট আছে ওটা করে দিয়েন।
তারপর যাত্রীদের সঙ্গে আমার কোনো সাক্ষাৎ বা কোনো কিছুই হয়নি। ট্রেনের গার্ডরাও আমাকে কোনো তথ্য দেননি যে তারা বিনা টিকিটে যাবেন কিনা, বা এরমক কিছু। হয়তো স্যারের সঙ্গে তাদের (গার্ড) কথা হতে পারে, কিন্তু আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। তারপর যথারীতি গাড়ি (ট্রেন) চালু হলে আমি যাত্রীদের টিকেট পরীক্ষা শুরু করি।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টিকেট পরীক্ষা শুরুর সময় ট্রেনের অপারেটরকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন কেবিনে তারা (মন্ত্রীর আত্মীয়) আছেন? আমাকে দেখানোর পর আমি সেখানে যাই।
আমি তাদেরকে (যাত্রীদের) সম্মানের সঙ্গে বললাম, আপনাদের তো মনে হয় কোনো টিকিট নেই। আমাকে এসিও স্যার যেহেতু বলেছেন, তাই আপনাদের নরমাল যে ভাড়াটা সেটা দিন, আমি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেই। তখন তারা বললেন, কত টাকা ভাড়া। আমি বললাম, তিনজনের জনপ্রতি ৩৫০ টাকা হারে ১ হাজার ৫০ টাকা। এর মাঝে আমি তাদের একটা উপদেশ দিয়েছিলাম, যে কেবিনের নিচেরটা পেড়ে নিন তাহলে আপনাদের ঘুমানোর জন্য সুবিধা হবে। কিন্তু এ সময় তারা কোনো কথা বলেননি। আমি তাদের ভাড়া আদায়ের রশিদ দিয়ে চলে গেছি। এছাড়া তাদের সঙ্গে আমার আর কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে কী কারণে, কীসের জন্য আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল, সেটি আমি বুঝতেই পারিনি। ’
মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় পাওয়ার পরও তাদের জরিমানা করেছেন কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ বাড়তি ভাড়ার টিকেট ছাড়া আমি যেহেতু টিকিট ইস্যু করতে পারি না। তাই তাদেরকে জরিমানাসহ টিকেট দিয়েছি। ঈশ্বরদী থেকে ঢাকার কাউন্টার ভাড়া ২৯৫ টাকা, জরিমানাসহ জনপ্রতি ৩৫০ টাকা করে ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়েছি। তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি উপর ওয়ালাকে (আল্লাহ) সাক্ষী রেখে বলছি, আমার সঙ্গে তাদের এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তারা কী কারণে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল আমি সেটা জানি না, বলতেও পারব না। আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠিয়েছে, আমি স্যার ও তদন্ত কমিটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
এদিন সকাল ১০টা থেকে পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা দুপুর ১২টা গড়িয়ে যায়। এর মধ্যে তদন্ত কমিটির সব সদস্য হাজির হন।
এরপরই সাংবাদিকদের সামনে প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে বহাল করেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক শাহিদুল ইসলাম।
এই খবর শোনার পরে টিটিই শফিকুল বলেন, ‘আমাকে ফের কাজের সুযোগ দেওয়ায় খুব খুশি হয়েছি। আমি কোনো অন্যায় করিনি, ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছি। আশা করছি সঠিক তদন্ত করে এ ঘটনার সঠিক প্রতিবেদন জমা দেবেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এছাড়া আমার কিছু বলার নেই। ’
এর আগে গত শনিবার ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলামকে প্রধান এবং সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) শিপন আলী ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী কমান্ডেন্ট (এসিআরএনবি) আবু হেনা মোস্তফা কামালকে সদস্য করা হয়। তদন্তের মেয়াদ দুই দিনের স্থলে বাড়িয়ে চার দিন করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সেদিনের ওই কেবিনে রেল সংশ্লিষ্ট ও যাত্রী যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার সঠিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন রেলওয়ের পাকশী বিভাগের ব্যবস্থাপক শাহিদুল ইসলাম।
Leave a Reply