বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে। এই বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে লজিস্টিকস খাতের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষ লজিস্টিকস খাত বাংলাদেশের রপ্তানি ২০ শতাংশ বাড়াতে পারে। দেশের অগ্রগতির জন্যই লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নে সমন্বিত নীতিমালা দরকার। যেখানে থাকবে এই খাতের নীতিসহায়তা।

লজিস্টিকস খাতের অন্যতম সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং। আমদানি বা রপ্তানি পণ্য গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের। রপ্তানিকারক থেকে পণ্য বুঝে নিয়ে সঠিক পরিবহনের মাধ্যমে তা আমদানিকারকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। দেশে লজিস্টিকস-সুবিধার ওপর নির্ভর করে, এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ কতটুকু সেবা দিতে পারবে।

ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন হলো বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশন বা বাফা। বর্তমানে ১ হাজার ১০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে সহায়তাকারী হিসেবে যুক্ত রয়েছে।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাত এখনো আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে রয়েছে। বৈশ্বিক সূচকে আমরা এখনো দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের পেছনে। বিশ্বের শীর্ষ লজিস্টিকস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাজিলিটি লজিস্টিকস ২০২২ সালে উদীয়মান ৫০টি দেশের লজিস্টিকস নিয়ে সূচক তৈরি করেছে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৯তম। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পেছনে বাংলাদেশের অবস্থান।

কেন আমরা পিছিয়ে আছি তা ব্যাখ্যা করা যাক। লজিস্টিকস খাতের প্রধান অবকাঠামো হলো বন্দর। বাংলাদেশে বন্দরগুলোর প্রচলিত ব্যবস্থায় আমদানি পণ্যের বড় অংশই এখনো বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় কনটেইনার খুলে ডেলিভারি দেওয়া হয়। এটা বিশ্বের কোনো বন্দরেই নেই। প্রথমে এই ডেলিভারি ব্যবস্থা বন্দরের বাইরে নিতে হবে। এই ডেলিভারি ব্যবস্থা বন্দরের সংরক্ষিত এলাকা থেকে হওয়ায় যানজট হচ্ছে। বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে আমদানি-রপ্তানি পণ্য ওঠানো-নামানোসংক্রান্ত কার্যক্রমে গতি আনা যাচ্ছে না।

বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন বা শেডগুলোতে এলসিএল কনটেইনারে পণ্য খুলে রাখা হয়। এরপর আমদানিকারক অনুযায়ী তা খালাস নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা এখনো বন্দরের হাতে রয়ে গেছে। এলসিএল কনটেইনারে মূলত রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালই বেশি। বিশ্বব্যাপী কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা পরিচালনা করে। যেমন ভারতে ৪০০-এর বেশি সিএফএস লাইসেন্স রয়েছে, যেগুলো ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়াও রয়েছে ১ হাজারের বেশি।

রপ্তানিপণ্য কনটেইনারে স্টাফিংয়ের ব্যবস্থাও একসময় বন্দরের অভ্যন্তরে ছিল। দুই দশক আগে থেকে তা বন্দরের বাইরে নেওয়া হয়। এজন্য বেসরকারি কনটেইনার ডিপো পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া শুরু করে সরকার। এই ব্যবস্থার কারণে রপ্তানিপণ্য স্টাফিংয়ে বন্দরের ওপর চাপ সরে গেছে। রপ্তানির মতো আমদানিপণ্য ডেলিভারির ব্যবস্থা বাইরে করা দরকার। বর্তমানে ৩৮ ধরনের পণ্য শুধু বন্দরের বাইরে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে খালাস করা বাধ্যতামূলক। এটা পুরোপুরি বাইরে সরিয়ে নেওয়া দরকার। এজন্য বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগকারীরা যাতে এগিয়ে আসে, সেজন্য এই খাতেও নীতি-সহায়তা দেওয়া দরকার।
বর্তমান সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চলে উত্পাদন শুরু হয়েছে। রপ্তানিও হচ্ছে। মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের মতো বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা উত্পাদন শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে পুরোদমে উত্পাদন শুরু হবে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানার পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে দরকার হবে দক্ষ লজিস্টকস ব্যবস্থাপনা। দক্ষ মানবসম্পদও গড়ে তুলতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাজার অর্থনীতির সঙ্গে টিকে থাকার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপযুক্ত নিয়ম ও প্রবিধান প্রণয়ন করতে হবে। উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে ৯টি মন্ত্রণালয় এবং ২১টি বিভাগ দেশের লজিস্টিকস খাতের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে, যা লজিস্টিকস শিল্পের কার্যকারিতাকে জটিল করে তুলছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভারত ২০১৫ সালে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উন্নীত করতে এবং একটি দক্ষ লজিস্টিকস-অবকাঠামো এবং পরিষেবা খাত গড়ে তুলতে বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীনে একটি পৃথক বিভাগ (যেমন, লজিস্টিকস বিভাগ) গঠন করেছে। সিঙ্গাপুর দক্ষ লজিস্টিকস সেবার বড় উদাহরণ যা দেশটিকে প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছে।

এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, আমাদের লজিস্টিকস সূচককে বৈশ্বিক মানের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সহজে ব্যবসায় করার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত নীতিসহায়তা প্রণয়ন করতে হবে। ব্যবসা করার খরচ কমাতে নীতিসহায়তা প্রণয়ন করা দরকার।
আবার সরকারি খাতে অবকাঠামোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের লজিস্টিকস অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের ব্যবহারকারীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সামঞ্জস্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিধি এবং প্রবিধান প্রণয়ন করে। আমাদের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, যা বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৯ সালের গুদাম অধ্যাদেশ বর্তমান ব্যবস্থায় উপযোগিতা নেই। লজিস্টিকস খাতের তত্ত্বাবধানের জন্য একটি একক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। ৯টি মন্ত্রণালয় ও ২১টি বিভাগের তত্ত্বাবধান প্রত্যাহার করা হলে এই খাতের উন্নয়নে গতিশীল ভূমিকা রাখবে। সহজেই অনেক অযৌক্তিক বাধা অপসারিত হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়ম ও বিধিবিধান মেনে চলতে হলে দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি। অবকাঠামোর পাশাপাশি লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নে দক্ষ জনবল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ)-এর সহায়তায় বাফা সিআইইউবির সঙ্গে ‘ডিপ্লোমা ইন লজিস্টিকস অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট’ চালু করতে যাচ্ছে। আশা করি, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে লজিস্টিকস খাতে পরিষেবা দেওয়ার জন্য যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা দরকার। ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করা গেলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা থাকবে। দক্ষ জনবল দেশে চাকরির পাশাপাশি বিদেশেও চাহিদা রয়েছে। অদক্ষ জনশক্তির চেয়ে দক্ষ জনশক্তি রেমিট্যান্স আয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে।

আবারও প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ দিতে হয়। ভারত ২০২১ সালের মধ্যে ১০ কোটি লোকের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি খাতের সঙ্গে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের অধীনে এবং শুধু লজিস্টিকস সেক্টরে ২২ লাখ মানবসম্পদ দিয়ে এটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, নীতিনির্ধারকসহ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সব ব্যবহারকারী বা স্টেকহোল্ডার ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের গুরুত্ব অনুধাবন করতে এবং সমন্বিত ও সমন্বিত উপায়ে যথাযথ নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি করতে এগিয়ে আসবে। এটি করা গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ সফলভাবে অর্জনে সহায়তা করবে। উৎস: ইত্তেফাক
লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফা)।
Leave a Reply