সড়ক নিরাপত্তা জোরদার ও দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিমাণ কমিয়ে আনতে শুরু হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের কার্যক্রম। প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পটির মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের দুটি মহাসড়ককে নিরাপদ করিডোর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পাঁচ বিভাগে মহাসড়ক ও শহরাঞ্চলের সড়কগুলোর নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রকল্প কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পটিতে সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা ঋণসহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। বাকি ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

‘বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্ট’-এর মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে নিরাপদ করিডোর হিসেবে গড়ে তোলা হবে জাতীয় মহাসড়ক এন-৪-এর গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশের ৭০ কিলোমিটার এবং এন-৬-এর নাটোর-নবাবগঞ্জের ৭০ কিলোমিটার অংশ। সড়ক দুটির প্রকৌশলগত নকশা উন্নয়ন, সাইন ও মার্কিং স্থাপন, পথচারী চলাচল সুবিধা বৃদ্ধি, গতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চালু করা হবে জরুরি সেবার ব্যবস্থা।
সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের আওতায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে সড়ক নিরাপত্তায় কাজ করবে। এর মধ্যে সওজ অধিদপ্তর বিদ্যমান মহাসড়ক দুটির প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ করবে। পর্যাপ্ত সাইন-সিগন্যাল স্থাপন, পার্কিং ও যানবাহন মেরামতের জায়গা নির্ধারণসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করবে সংস্থাটি।
অন্যদিকে মহাসড়ক দুটির শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ। এজন্য একটি স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হবে। সড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চিহ্নিত, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরবরাহ করা হবে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। পাশাপাশি মহাসড়ক দুটি সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হবে। একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে যানবাহন চলাচলসহ মহাসড়ক দুটি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এসব কাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে বিআরটিএ। পাশাপাশি পরিবহনচালক, যাত্রী, পথচারীসহ সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবে সংস্থা দুটি।

দুর্ঘটনায় হতাহতদের চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক লাইফ সাপোর্ট সুবিধা সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স প্রাপ্তির জন্য কাজ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অ্যাম্বুলেন্সটি প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। আহত যাত্রীকে বিনামূল্যে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছে দেবে এ অ্যাম্বুলেন্স। পাশাপাশি দুর্ঘটনাস্থলেই আহত যাত্রীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য থাকবে একটি বিশেষ ইউনিট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজটি করবে। এসব কাজের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুসরণ করে মহাসড়ক দুটিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, সরঞ্জাম সরবরাহ এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োজিত রাখা হবে।
এ দুই মহাসড়ক ছাড়াও প্রকল্পটির মাধ্যমে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করা হবে। বিশেষ করে এসব বিভাগের মহাসড়ক ও শহরাঞ্চলের সড়ককে নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সাইন-সিগন্যাল স্থাপন, সড়ক বিভাজক, ফুটপাত, জেব্রা ক্রসিং, গতি নিয়ন্ত্রক ও বাস-বের মতো অনুষঙ্গ যুক্ত করা হবে সড়ক-মহাসড়কগুলোয়।

গতকাল অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছি। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যতই উন্নয়ন করি, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, একদিনে ১০০ সেতু উদ্বোধন করি, তার পরও যখন দুর্ঘটনার খবর দেখি, তখন মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এটা অত্যন্ত কষ্টের। আমরা মন্ত্রী হলেও তো মানুষ। এ দুর্ঘটনা আমাদের মনে কষ্ট দেয়। এত মেগা প্রজেক্ট, এত উন্নয়ন করার পরও স্বস্তি পাই না দুর্ঘটনার কারণে। কেন হবে? আমরা কি এটা এড়াতে পারি না? সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হয়। আমাদের ভাবনার চেয়ে বাস্তবায়ন খুবই ধীরগতি।’

অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলায়ে সেক বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। যুবকরা সমভাবে প্রভাবিত হয়। সড়ক দুর্ঘটনা একটি দেশের প্রবৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নকে দুর্বল করে। বাংলাদেশের জন্য সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করা একটি প্রধান উন্নয়ন অগ্রাধিকার। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জনগণের জন্য সড়ক নিরাপদ করতে সহায়তা করছে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন। পরবর্তী সময়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (অপরাধ ও অপারেশন) আতিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার ও বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের রোড সেফটি প্রজেক্টের সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট স্পেশালিস্ট দীপন বোস।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ট্রান্সপোর্ট প্র্যাকটিস ম্যানেজার ফেই ডেং ও বিশ্বব্যাংকের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ভাইস প্রেসিডেন্ট গুয়ানজে চেন বক্তব্য রাখেন।
Leave a Reply