অনেক দিন আগের কথা। এক যুগের বেশি তো হবেই। বাংলা মোটর বা ফার্মগেট এরকম কোথাও থেকে বাসে করে যাচ্ছিলাম শাহবাগ। অল্প পথ। ভাড়া বোধহয় ছিল দুই টাকা। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। শাহবাগের মোড় পর্যন্ত বাস যেতে দেয়া হলো না। তখনকার শেরাটন হোটেলের মোড়ে বাস ঘুরিয়ে দেয়া হল। আমি নেমে গেলাম। কিন্তু নামার আগে বাসের কন্ডাক্টর ছেলেটির সাথে কিছু কথা বার্তা হয়েছিল। জেনেছিলাম, তার নাম কামরুল। তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা। আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট। মাস খানেক পর আবার তার বাসে উঠলাম। কাকতালীয়ভাবেই। এবং তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কামরুল না? তোমার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা না? (তখন বয়সে ছোট বাস-কন্ডাক্টর বা হেল্পারদের আমি ‘তুমি’ সম্বোধন করতাম) সে থতমত খেয়ে গেল। একটু দ্বিধা সন্দেহ নিয়েই আমার সাথে কথা বলল এবং স্বীকার করল যে তার নাম ও বাড়ি ঠিক বলেছি আমি। আমি বললাম, গত পহেলা বৈশাখের দিন সকালে আমি তোমার বাসে করে শাহবাগ গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হয়েছিল। সে মনে করতে পারল না। না পারাই স্বাভাবিক। প্রতিদিন শত শত নতুন মানুষের সাথে যার কথা বলতে হয়, কথা কাটাকাটি করতে হয় তার এটা মনে না থাকারই কথা।

কিন্তু সে খুব খুশি হল যে আমি তার নাম মনে রেখেছি, বাড়ি মনে রেখেছি। এতই খুশি হল যে আমাকে শাহবাগ নামতে দিতে চাচ্ছিল না। আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল তার শেষ গন্তব্য গুলিস্তানে। কেন? আমাকে এক কাপ চা খাওয়াবে। আমার প্রতি তার মমতা, আন্তরিকতা এত বছর পরও আমাকে অভিভূত করে। আর আমি এই ঘটনা যতবার বলি, যতবার স্মরণ করি ততবার উপলব্ধি করি – খেটে খাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বঞ্চিত, বহুবিধ সুবিধা-বঞ্চিত, সমাজের সবচেয়ে নীচু তলার মানুষ বলে বিবেচিত, নিম্ন আয়ের এইসব মানুষ একটু মমতা পেলে কত সুন্দর অমায়িক আচরণ করতে পারে। যারা সাধারণভাবে দুর্ব্যবহারের জন্যই সমাজে পরিচিত। যাদের অমানবিকতার কথা মিডিয়া মারফত আমরা হরদম জানতে পারি।

লোকাল বাসে যতবার চড়ি ততবার সহযাত্রীদের দুর্ব্যবহার দেখে আমার মনে পড়ে কামরুলের ওই ঘটনার কথা। ওর সাথে আর দেখা হয় নি। কিন্তু ওর মমতাটুকু মনে রয়ে গেছে। (ওর সাথেও হয়তো আজ কেউ বাজে আচরণ করেছে। আমি জানি না। জানলেও তার প্রতিবিধান করার ক্ষমতা আমার নেই) আমার বিশ্বাস, এই মমতা ওদের পেশার সকলের মধ্যেই আছে, কম-বেশি। যাত্রীদের রুক্ষ্ণ আচরণের জন্য তা প্রকাশ হয় না। মিডিয়ায় প্রকাশ হয় শুধু পরিবহন শ্রমিকদের রূঢ় আচরণের কথা। অথচ তারা যে মানের পরিবেশে বাস করে, বাস টার্মিনালে যেভাবে তারা ঘুমায়, প্রতিদিন শত শত যাত্রীর কাছে যে দুর্ব্যবহার পায়, যে নিম্ন আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয় তার কোন খবর প্রকাশ হতে দেখি না।

মিডিয়ায় প্রকাশ হয় তাদের খারাপ দিকটাই (বস্তুত, সবার মাঝেই খারাপ দিক আছে। ভাল-খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ!)। অথচ তারা যে অনেক যাত্রীকেই বিনা ভাড়ায় বা কম ভাড়ায় নিয়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে তা প্রকাশ হয় না (ঢাকার ভেতর ও বাইরে এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই)।

কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে উঠতে হয় এমন বাস কিংবা এসি বাস ইত্যাদিতে যাত্রীদের দুর্ব্যবহারের পরিমাণ খুবই কম, নেই বললেই চলে। যেরকম দুর্ব্যবহার নেই উবার বা ট্যাক্সি ক্যাব চালকের সাথে। (কিন্তু দুর্ব্যবহার আছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল চালক রিকশাওয়ালা, অটো-রিকশাওয়ালার সাথে।) আমার ধারণা (ভুল হলে শুধরে নিতে প্রস্তুত আছি), দুর্ব্যবহার না থাকার কারণ ওইসব পরিবহনে আসা যাওয়া করা যাত্রীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অন্য কিছুর আধিক্য নয়। বরং সিস্টেম।

সব ধরনের বাস/গণ পরিবহনকে কি ওই সিস্টেমে আনা যায় না? যত দিন সেটা না যাচ্ছে ততদিন ভিন্ন কিছু করা তো যায়। ভাবছি ‘শুদ্ধাচার’ বইয়ের ‘যাত্রী হিসেবে পালনীয় শুদ্ধাচার’ অংশ থেকে কিছু পয়েন্ট প্রিন্ট করে বাসে বাসে লাগিয়ে দেবো। যদি যাত্রীদের মাঝে কিছু বোধের উদয় হয়।
লেখক : সমাজকর্মী। ১৩/৩/২০২২
Leave a Reply