রেলওয়ের দুই অঞ্চলে (পূর্ব-পশ্চিম) বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার তেল চুরি হচ্ছে। লোকোশেড ছাড়াও পাওয়ার কার, ডিপো ও ট্রেন ইঞ্জিন থেকেই চুরির ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে স্টেশন মাস্টার, ডিপো ইনচার্জ, গার্ড, ট্রেনচালক ছাড়াও সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট। মাঝে-মধ্যে ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে আবারও সক্রিয় হয় চুরিতে।
জানা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম মিলে ২৪ ঘণ্টায় দেশের চারটি সেকশনে তিন শতাধিক এক্সপ্রেস, মেইল, লোকাল ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করে।
বর্তমানে ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রেলপথ আছে। ৪৪টি জেলায় বর্তমানে এসব ট্রেন চলাচল করে। এ সংখ্যক ট্রেন চলাচলে ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার লিটার তেলের প্রয়োজন হয়। এ হিসাবে বছরে ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার লিটার তেল লাগে। রেলওয়ে নিরাপত্তা বিভাগের আনুমানিক হিসাব মতে, সারা দেশের রেলপথে দৈনিক গড়ে ৪৫ হাজার লিটার তেল পাচার ও চুরি হয়। বছরে যে পরিমাণ তেল পাচার হয় তার দাম ১০০ কোটি টাকার বেশি।
পশ্চিম রেলের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা (আরএনবি) আশাবুল ইসলাম বলেন, কোনো ট্রেনে আপ-ডাউনে ৫ হাজার লিটার তেলের দরকার হয়। কিন্তু ডিপোকে ম্যানেজ করে পাওয়ার কার বা ইঞ্জিনে আরও ১ হাজার লিটার অতিরিক্ত তেল নেওয়া হয়। অতিরিক্ত তেলটা পথে পাচার করে দেওয়া হয়। রেল থেকে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি তেল পাচার ও চুরি হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি তেল চুরি ও পাচার হয় পাকশী বিভাগের আবদুলপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, আমনুরা, হাতীবান্ধা, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, ললিতনগর, সান্তাহার, কাউনিয়া, চাটমোহর, বালাসী রেল ডিপো, পোড়াদহ, কালুখালী, দৌলতদিয়া, নওয়াপাড়া, রহনপুর, দর্শনা ও নাটোর স্টেশনে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৯২ ট্রেনের মধ্যে ১৮৩টিতেই তেল চুরি হয় বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া দুই অঞ্চলের মালবাহী ট্রেন থেকে তেল চুরির ঘটনাও ঘটে। পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ বলেন, তেল পাচার ঠেকাতে ইতিমধ্যে পশ্চিম রেল বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আরএনবি এখন অনেক বেশি সক্রিয়। তারা প্রায়ই অভিযান চালায়।
জানা গেছে, ২১ অক্টোবর বিকাল ৫টায় ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে বিরতিহীন বনলতা এক্সপ্রেস থামিয়ে পাওয়ার কার থেকে তেল পাচারের সময় ১২০ লিটার তেলসহ আবদুল হাকিম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আরএনবি।
অভিযান পরিচালনাকারী ঈশ্বরদী রেল নিরাপত্তা বাহিনীর পরিদর্শক ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, আবদুল হাকিম আগেও তিনবার তেলসহ গ্রেফতার হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ঈশ্বরদী আরএনবি ফাঁড়িতে মামলা হয়েছে। ঈশ্বরদী বাইপাসে বনলতা ট্রেনের স্টপেজ না থাকলেও চালক ও গার্ডরা সেখানে ট্রেন থামিয়ে তেল পাচারের সুযোগ করে দেন। ২৯ আগস্ট সকালে লালমনিরহাট রেলওয়ে ডিভিশনের মহেন্দ্রনগর রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় রেলওয়ের তিন কর্মচারী চোরচক্রের একজনের যোগসাজশে চলন্ত ট্রেন ২০ ডাউন-এর সংযুক্ত বগি স্টোরভ্যান থেকে মবিলভর্তি তিনটি ড্রাম ও ডিজেলভর্তি দুটি জ্যারিকেন নিচে ফেলে দিয়ে চলে যায়। পরে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী লালমনিরহাটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম রাসুল সরকার ওই ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া তিনটি ড্রামভর্তি ৬২৪ লিটার মবিল ও দুটি জ্যারিকেনভর্তি ৩০ লিটার ডিজেল উদ্ধার করেন। এ সময় মবিল চোর সিন্ডিকেটের দুই সদস্যকে আটক করা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর চার সদস্যের ওপর হামলা চালিয়ে আটক দুজনকে ছিনিয়ে নেয়। ১৭ মে রেলওয়ের লোকোমোটিভ থেকে ওঠানো ৬৪৪ লিটার তেল নির্ধারিত পিডব্লিউআই অফিসে না নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করার সময় রেলওয়ে শ্রমিক লীগ ঈশ্বরদী শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকনকে আটক করে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা। রোকন রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ অফিসের অধীনে ওয়েম্যান হিসেবে কাজ করেন। ঈশ্বরদীর কদমতলা এলাকার মেসার্স আবেদা এন্টারপ্রাইজের মালিক আহমদ আলীর কাছে তেল বিক্রি করার সময় তাকে আটক করা হয়।
২৩ এপ্রিল দুপুরে রাজশাহী রেলস্টেশনে চোরাই তেল ট্যাংকারে ভরার সময় আরএনবি ৫ হাজার লিটার তেলের সঙ্গে রেলের ডিপো ইনচার্জ উপসহকারী প্রকৌশলী আবুল হাসানসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছেন।
পশ্চিম রেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বনলতা এক্সপ্রেসের মতো অভিজাত ট্রেনের সুরক্ষিত পাওয়ার কারে চোর ঢুকে তেল চুরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদি ট্রেনে দায়িত্বরত কেউ সেই সুযোগ না করে দেন। তেল চোর হাকিম গ্রেফতার হলেও বনলতার পাওয়ার কারে দায়িত্বরত কাউকে আটক করা হয়নি।
Leave a Reply