শীত নামছে ধীরে ধীরে। উত্তরাঞ্চলে শীত পড়লেও দেশের উপকূলীয় এলাকায় এখনো উষ্ণতার আবেশ। তাই পর্যটন স্পট কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ঢল নেমেছে ভ্রমণপিপাসুদের। করোনাভাইরাস
সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে সেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই দেখা যাচ্ছে না। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কক্সবাজার-কুয়াকাটাসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলো এই সময়টায় বেশ পরিপূর্ণ থাকে। বিশেষ করে সমুদ্র সৈকতগুলো পর্যটকের কোলাহলে মুখরিত হয়। তবে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে এবার চিত্রটা ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। কলাতলী, সুগন্ধা, ইনানী এমন কোনো স্পট নেই যেখানে পর্যটকরা ভিড় করছেন না।
করোনায় সচেতনতার অংশ হিসেবে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলেও তা মানা হচ্ছে না এসব পর্যটনকেন্দ্রে। কেউ মানছেন না সামাজিক দূরত্বও। এক কথায় কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষ এসব পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় করছেন। এসব জায়গার পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠা হোটেল- মোটেলগুলোতেও নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাস প্রথমধাপে বড়সড় ধাক্কা দিয়ে গেছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ধাপেও বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় জোয়ারের মাঝেই কক্সবাজারসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো যে হারে জনসমাগম হচ্ছে তাতে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
সরজমিন দেখা যায়, শুক্রবার সকাল থেকেই কক্সবাজারের কলাতলী বিচে কয়েক হাজার পর্যটক। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা এসব পর্যটকের অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। কারো কারো মাস্ক থাকলেও তা মুখের বদলে গলার দিকে নামানো। তাছাড়া একই পরিবার কিংবা বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা দূরত্ব বজায় ছাড়াই বিচের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাতে করোনাভাইরসা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অনেকাংশে। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সংশ্লিষ্টদের সচেতনতামূলক নির্দেশনা থাকলেও আদতে কেউ মানছেন না।
আগত পর্যটকরা সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি দরিয়ানগর, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানীর পাথুরে সৈকত, রামু বৌদ্ধ বিহার, মহেশখালী আদিনাথ মন্দিরসহ জেলার পর্যটন স্পটগুলোতেও ঢুঁ মারছেন।
কক্সবাজার হোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের প্রায় সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজে রয়েছে, যেখানে লক্ষাধিক পর্যটক অবস্থান করতে পারেন। সাপ্তাহিক ছুটিতেও প্রায় লাখো পর্যটক কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। শতভাগ বুকিংয়ে জমজমাট ব্যবসা করছে তারকা হোটেলগুলো। নামকরা হোটেল ছাড়া বেশির ভাগ হোটেলে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি সূত্র জানায়, আগত পর্যটকদের সেবা নিশ্চিতে সর্তক অবস্থায় দায়িত্বপালন করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। সাপ্তাহিক ছুটিতে পর্যটক সমাগম বাড়ে দেখে মোতায়েন রাখা হয় অতিরিক্ত পুলিশও। পর্যটক হয়রানি রোধে পর্যটন স্পটগুলোকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত সাধারণ চিকিৎসা ও খাবার পানির ব্যবস্থা রয়েছে সমুদ্র সৈকতে। গোসলকরাকালীন বিপদাপন্ন পর্যটকদের রক্ষার্থে সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন লাইফগার্ড কর্মীরা।
রাঙ্গামাটি থেকে আসা সোহেল আরমান দম্পতি জানান, করোনা একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ির সবাই আতঙ্ক নিয়ে কাটিয়েছি দীর্ঘ ৬ মাস। এখন আবার দ্বিতীয় ফ্লু শুরুর শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। তাই মানসিক প্রশান্তির আশায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে সৈকতের নোনাজলের সান্নিধ্য নিতে এসেছি। পরিবারসহ খুবই মজা করছি।
সি-সেফ লাইফগার্ড সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, দুর্গাপূজার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন পর্যটকরা সৈকতে ভিড় বাড়াচ্ছেন। শুক্র ও শনিবার এ মাত্রা বাড়ে। করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রতিনিয়ত মাইকিং করা হলেও বালিয়াড়িতে আসা পর্যটকদের অধিকাংশই মাস্ক পরে না। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় অব্যাহত রাখলেও পর্যটকরা সচেতন হচ্ছেন না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোরাদ ইসলাম জানান, পর্যটক হয়রানি বন্ধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় মূল্য তালিকা টাঙানোর নির্দেশনা আগেই দেয়া ছিল। সমুদ্র সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ ১১টি পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র (ইনবক্স)। পাশাপাশি দেয়া হয়েছে একটি হটলাইন নম্বর। যে কোনো অভিযোগ এখানে করতে পারবে পর্যটকরা। হটলাইনের সেবা নিয়ে ইতিপূর্বে অগণিত পর্যটক হয়রানির বিচার পেয়েছেন। জরিমানা করা হয়েছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও হোটেলকে। এখন করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সর্বদা সচেতনতামূলক মাইকিং ও প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সবসময় সর্তকাবস্থায় রয়েছে পুলিশ। পর্যটকরা যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানির শিকার না হন, পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেএবং পর্যটক বেশে পুরুষ-মহিলা পুলিশের সংখ্যাও সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকত এলাকায় পোশাকধারী পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের বিশেষ রেসকিউ টিম, ইভটিজিং কন্ট্রোল টিম, ড্রিংকিং জোন, দ্রুত চিকিৎসাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে পর্যটকদের নিরাপত্তায়। সৈকতে বিচ বাইক নিয়ে টহল অব্যাহত রেখেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। রয়েছে ৩টি বেসরকারি লাইফ গার্ড সংস্থার অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড কর্মী। কন্ট্রোল রুম, পর্যবেক্ষণ টাওয়াসহ পুরো সৈকতে পুলিশের নজরদারির আওতায় রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা মাথায় রেখে অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ‘পরীক্ষামূলক খুলে দেয়া’ হয়। সামনে পর্যটন মৌসুম আসছে। আবার করোনার দ্বিতীয় ফ্লো’র শঙ্কার কথাও ঘোষণা এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা রোধের পাশাপাশি পর্যটনটাও এগিয়ে নিতে হবে। সেভাবেই পর্যটন সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেয়া রয়েছে। সবাই আন্তরিক হলে পর্যটন ব্যবসা ঠিক রেখে করোনা রোধ সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
কক্সবাজারের মতো কুয়াকাটায়ও পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলে দলে পর্যটকরা এলেও অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ভিড়ে করোনা সংক্রমণ নিয়ে শঙ্কায় স্থানীয়রা। যদিও স্থানীয় প্রশাসনের দাবি পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
Leave a Reply