ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াবের প্রাথমিক হিসাব
করোনা তাণ্ডবে দেশের পর্যটন খাতের ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৫ হাজার ৭শ’ কোটি টাকা। বেসরকারী ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াবের প্রাথমিক হিসাবে এমনটি দাবি করা হচ্ছে। এ দাবি কতটুকু সত্যি তা যাচাই করার জন্য বিআইডিএস নামের একটি দায়িত্বশীল সংস্থা দিয়ে জরিপের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। বিটিবির চেয়াম্যান জাবেদ আহমেদ জানিয়েছেন- গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে শুধু ব্যবসায়িক টার্নওভার হওয়ার কথা ছিল ৫ হাজার ৭ শ’ কোটি টাকা। সেটা হয়নি। আর না হওয়াতে ১৫ শত কোটি টাকার লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। যদি আগামী মার্চ পর্যন্ত করোনার খারাপ সময় হিসেবে ধরা হয় তাহলে তখন এ খাত বঞ্চিত হবে কমপক্ষে ১৫ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার থেকে। এ সবই বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণায়। এছাড়া বৈশ্বিক পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৩৫ হাজার কোটি ডলার। পরিণামে বিশ্বজুড়ে ১৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। মহামারীর চলমান বছরের শেষ নাগাদ ৩৫ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির তৃতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত।
টোয়াব সভাপতি রাফিউজ্জমান জানান- ট্যুরিজম বলতে শুধু হোটেল মোটেল বা পর্যটন কেন্দ্র বোঝায় না। এয়ারলাইন্সও কিন্তু পর্যটনের অংশ। সে হিসাব এর বাইরে রয়ে গেছে। যদিও বিশ্বব্যাপী ট্যুর ও এয়ারলাইন্সকে একই কাতারে দেখা হয়। বিগত মার্চ মাস থেকে নবেম্বর পর্যন্ত ৫৭ শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু চলমান শীতেই অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে এ খাত। তখন সে ক্ষতি গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
রাফিউজ্জামান বলেন- চলমান শীত মওসুমে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশের পর্যটন খাত যে আর স্বাভাবিক হবে না এটা ধরেই নিয়েছি। যদিও কক্সবাজারসহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ধীরে ধীরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। জানুয়ারি মাসে শীতের তীব্রতা বাড়লে এ সংখ্যা কমে আসতে পারে। আবার এপ্রিল থেকে গরম শুরু হলে দ্বিতীয় ধাক্কায় টিকার ধাক্কা লাগলে পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হবে বলে আশা করছি। তখনই পর্যটন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান রামচন্দ্র দাস জানান- গত মার্চ থেকেই সরকারী ব্যবস্থাপনার হোটেল মোটেলগুলোতে ব্যবসায় ধস নামে। এখনও পর্যন্ত সেটা আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। প্রতিমাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারী পর্যটন কেন্দ্রের। তাহলে দশ মাসে এ ক্ষতি কমপক্ষে দাঁড়ায় দশ হাজার কোটি টাকায়। শুধু টাকার অঙ্কে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে এভাবে মোট ক্ষতি নির্ধারণ করা যাবে না। এরসঙ্গে অন্যান্য ক্ষতির বিষয়টিও সম্পৃক্ত। চলমান ধাক্কা কবে নাগাদ সামাল দিয়ে কেটে ওঠা যাবে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন গোটা সময়ের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হলে জানা যাবে প্রকৃত চিত্র।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) চেয়ারম্যান জাবেদ আহমেদ জানান- দেশে গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত পর্যটন খাতের ক্ষতির পরিমাণ এখনও সঠিকভাবে নির্ধারণ বা মূল্যায়ন করা হয়নি। দেশে বর্তমানে সরকারী পর্যটন কর্পোরেশন ও বেসরকারী ট্যুর অপারেটরদের দেয়া তথ্য মতে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ৭ শ’ কোটির ওপরে ক্ষতি বলে দাবি করা হচ্ছে। এ সব দাবি কতটুকু সত্য মিথ্যা তার প্রকৃত অর্থে যাচাই করার জন্য বিআইডিএস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারবে। তখনই বলা যাবে প্রকৃতপক্ষে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে করোনায়।
এদিকে দেশের বাইরে গোটাবিশ্বে এ খাতের পরিমাণ কমপক্ষে ৩৫ হাজার কোটি ডলার হিসাবে প্রাথমিকভাবে প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে তিনি বলেন, জ্বালানি ও রাসায়নিক পদার্থের পর বৈশ্বিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৭ শতাংশই এসেছে এ খাত থেকে। পৃথিবীর প্রতি ১০টি চাকরির একটি আসে পর্যটন খাত থেকে। বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি মানুষকে বিশ্বের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ দেখার সুযোগ করে দেয়। মানুষকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন- ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসে করোনা মহামারীর কারণে, আন্তর্জাতিক পর্যটন অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। এটা উন্নত দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের আঘাত- কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি জরুরী অবস্থা তৈরি করেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বহু ছোট দ্বীপ ও আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য এটি জরুরী অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু দেশের মূল জিডিপির ২০ শতাংশেরও পর্যটন নির্ভরশীল। জাতিসংঘের বৈশ্বিক পর্যটন সংস্থার বাজার বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিযোগিতা বিষয়ক প্রধান সান্দ্রা কারভাও বলেন, গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পর্যটন শিল্প ৩২ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে। ২০০৯ সালের আর্থিক মন্দার সময়ের তুলনায় এটি তিন গুণ বেশি। তারপর মে থেকে গত নবেম্বর পর্যন্ত এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা। যা দিন দিনই কমে আসছে। জাতিসংঘের নীতিমালা ব্রিফিং অনুসারে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের রফতানি রাজস্ব চলতি বছর ৯১ হাজার কোটি ডলার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার কমার আশঙ্কা রয়েছে। তেমনটা হলে বৈশ্বিক জিডিপি ১.৫ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। পর্যটন শিল্পে লোকসান কেবল এই খাতের ওপরই প্রভাব ফেলবে না এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোকেও প্রভাবিত করবে। বিশ্বজুড়ে ১৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। এমতাবস্থায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ছোট আকারের ব্যবসাগুলো। পর্যটন বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণেও মুখ্য ভূমিকা রাখে। বিশ্বজুড়ে ৭ শতাংশ পর্যটনই বন্যপ্রাণী সংশ্লিষ্ট। এ খাতে লোকসান বন্যপ্রাণী শিকার ও প্রাণীদের বাসস্থান ধ্বংস বাড়িয়ে দিয়েছে।
Leave a Reply