নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নানা উদ্যোগের পরও পরিবর্তন আসেনি রাজধানীর গণপরিবহনে। সেই পুরনো কায়দায় যাত্রীদের জীবন বিপন্ন করে প্রতিনিয়ত বাস-মিনিবাসের প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতা চলছে। যাত্রীর আশায় ফাঁকা সড়কেও রেষারেষি করে বাস চালান চালকরা। এতে অসহায় যাত্রীরা বারণ করলেও চালকদের কানে পৌঁছে না যাত্রীদের সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ বাসচালক আইন-কানুন মানছেন না। অধিক যাত্রী ও মুনাফার লোভে কে কার আগে যাবেন, এ নিয়ে চালকদের এ দৌরাত্ম্য বছরের পর বছর চলে আসছে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে পদ্ধতিগত পরিবর্তন জরুরি।
যাত্রীরা বলছেন, চালকদের এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামানোর কেউ নেই। আর এ কারণেই রাজপথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলও বড় হচ্ছে। তারা বলছেন, রেষারেষি করে বাস চালাতে নিষেধ করলেও চালকরা শুনে না। হঠাৎ দুই বাসের ধাক্কাধাক্কিতে যাত্রীরাও আতকে ওঠেন।
শুক্রবার (১৮ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর নতুন বাজার, বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ক্লাসিক ভিক্টর, রাইদা, আকাশ, তুরাগ, রইস, রাজধানী, স্মার্ট উইনার, অছিম ও প্রচেষ্টা পরিবহন ফাঁকা সড়কে যাত্রী তুলতে রেষারেষি করে পাল্লা দিয়ে বাস চালাচ্ছে। একটার পেছনে আরেকটা লেগে আছে। সামনের বাস না সরলে পেছনের বাসটা সজোরে ধাক্কা মারছে। আবার কোনটা হঠাৎ করে বাসের মাথা আরেকটার সামনে এসে পথরোধ করছে।
শুধু এ বাসগুলো নয়, একই অবস্থা গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ সড়কে। শিকড়, বোরাক, আনন্দ কোম্পানির বাসগুলো চলাচল করে কোনও শৃঙ্খলা না মেনেই। মতিঝিলে এটিসিএল, এফটিসিএল, বাহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির বড় বাসগুলো একটার পেছনে আরেকটা লেগে আছে। যাত্রাবাড়ী থেকে আসা ৮ নম্বর রুটের বাসসহ অন্যান্য রুটের মিনিবাসগুলো কোনোটা একটার পেছনে, কিংবা কোনোটা আরেকটার সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের সামনেই প্রতিটি স্ট্যান্ডে বাস চালকরা যেখানে সেখানে বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি রাখেন, যাত্রী তোলেন। সিটগুলো যাত্রীতে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্ট্যান্ড ছাড়তে চান না। যাত্রীদের চাপাচাপিতে বাসটি যখন অপর স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায় তখন এর গতি থাকে বেপরোয়া। এক্ষেত্রেও কে কার আগে যাবে, তা নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তখন সড়ক দিয়ে পারাপার হতে থাকা পথচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের সহকারী মো. আকুল মিয়া বলেন, চালক-হেলপার ও আমি এ তিনজন মিলে বাসটির মালিকের কাছ থেকে লিজ নিয়েছি। এজন্য প্রতিদিন ওই মালিককে ১ হাজার ১০০ টাকা দিতে হয়। চাঁদা আরও ৯০০ টাকাসহ সব মিলিয়ে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা খরচ। এরপর যা থাকে সেটা আমরা তিনজনে ভাগ করি।
তিনি আরও বলেন, আমরা বাস চালাই। এতে মালিকের এক টাকাও লোকসান নেই। সন্ধ্যার পর তারা গুনে-গুনে টাকা বুঝে নেন। তাই যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতা না করলে আমরা খাব কী?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে পাঁচটি কোম্পানির অধীনে সিটি সার্ভিসের বাস পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকেও এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থাকবে না।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, আমরা যদি হাতিরঝিলের দিকে তাকাই তাহলেই সমাধান খুঁজে পাবো। দেখতে পাবেন সেখানে পুলিশ লাগে না। একই মানের চালক সুন্দরভাবে বাস চালাচ্ছেন। যাত্রীরা হাত তুললেও থামছেন না। নির্ধারিত স্থান থেকেই যাত্রী ওঠানামা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, হাতিরঝিলের এসব বাসচালকরা ঢাকারই। তারা সেখানে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালায় না। তারা কোনও দুর্ঘটনা করে না। কিন্তু এরাই আবার অন্য সড়কে এলে আচরণ পাল্টে ফেলে। কারণ সেখানে সিস্টেমের সমস্যা। হাতিরঝিল প্রকল্প গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঢাকাবাসী সড়কের বিশৃঙ্খলার সমাধান পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা সেটাকে কাজে লাগাইনি। বাংলানিউজ।
Leave a Reply