খাল বরাবর না গিয়ে জাহাজটা যখন খাল পাথালে হয়ে গেল বিপত্তি ঘটল ঠিক তখনই। জাহাজটা নেদারল্যান্ডসের পথে রওনা হয়ে এমনভাবে সুয়েজ খালে আটকাল যে আর নড়েও না, চড়েও না। খাল ট্র্যাফিকের অযোগ্য ঘোষিত হলো, খালের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে মহাসাগরে ও সাগরে জমতে থাকল একটার পর একটা বড় জাহাজ। হঠাৎ যেন অর্থনীতির সাপ্লাই চেইনটা ছিন্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করল ভয়ংকর সব ঋণাত্মক প্রভাব। পৃথিবীর সুদক্ষ সাপ্লাই চেইনের বিস্ময়কর সাফল্য নিয়ে যারা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, বড় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম গরম করেছেন তারা নতুন শিক্ষা পেলেন ‘সুয়েজ ফ্যাক্টর’ কিংবা ‘এভার গিভেন ফ্যাক্টর’ নিয়ে। অনিশ্চয়তার অর্থনীতির একটি বড় ধাক্কা বড় ধরনের ক্ষতি মেনে নিয়ে পৃথিবী আবার চলতে শুরু করল। তানজুঙ্গ পেলেপাস কন্টেইনার বন্দর থেকে যাত্রা করে সুয়েজের মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসের রটারভাম বন্দরে পৌঁছবে অতিকায় কন্টেইনার পরিবাহী জাহাজ এভার গিভেন। কিন্তু ২৩ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টার দিকে জাহাজটি আড়াআড়িভাবে খালের মধ্যে আটকে গেলে। ঝড়, বাত্যাপ্রবাহ, যান্ত্রিক ও প্রকৌশল বিপর্যয় কিংবা ভুল পরিচালনা বা কোনো হিউম্যান ফ্যাক্টর এই দুর্ঘটনার জন্য যাই জড়িত থাকুক না, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও সুয়েজ ক্রাইসিসের পর কোনো নেভিগেশন রুট বিশ্ব অর্থনীতিতে এতটা ধাক্কা দিতে পারেনি। পুরো এক সপ্তাহ ২৯ মার্চ পর্যন্ত দুই গোলার্ধের সংযোজক খালটি অনিচ্ছাকৃত জাহাজ ব্যারিকেডের কারণে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে ছিল। সব ধরনের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের প্রয়োগ করার পর জাহাজটি সরিয়ে এনে ইন্সপেকশন বে-তে রাখা হয়েছে। যদি জাহাজের কাঠামোগত কোনো ক্ষতি না হয়ে থাকে তাহলে রটারডাম বন্দরের দিকে রওনা হবে। কিন্তু ৩ এপ্রিল পর্যন্ত অবমুক্ত করা যায়নি এভার গিভেন।
গোল্ডেন ক্লাস কন্টেইনার
এভার গিভেন ‘গোল্ডেন ক্লাস’ কন্টেইনার জাহাজ পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজগুলোর একটি। এভারগ্রিন মেরিন কোম্পানির জন্য প্রস্তুত বৃহদাকৃতির ১১টি জাহাজের একটি সিরিজ হচ্ছে গোল্ডেন ক্লাস। জাহাজগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের ইমাবারি শিপ বিল্ডিং। সাইজু শিপইয়ার্ডে প্রস্তুত হয় ৫টি জাহাজ এবং মারুগেম শিপইয়ার্ডে ৬টি প্রথম জাহাজ ডেলিভারি হয় ৩০ মার্চ ২০১৮ এবং শেষ জাহাজটি ১৫ অক্টোবর ২০১৯। প্রথম জাহাজটির নাম এভার গোল্ডেন এবং শেষটি এভার গ্রিট। বাকি নয়টি জাহাজ হচ্ছে : এভার জিনিয়াস, এভার গিফটেড, এভার গ্লোরি, এভার গ্লোব, এভার গুডস, এভার গিভেন, এভার গ্রেড, এভার জেন্টল এবং এভার গভার্ন। এই ১১টির মধ্যে এভার গোল্ডেন ধারণক্ষমতার দিক থেকে সবচেয়ে বড়। এর ডেডওয়েট টনেজ ২,১৮,০০০ মেট্রিক টন। ডেডওয়েট মানে হচ্ছে সর্বাধিক কার্গোসহ জাহাজ, ক্রু, তেল, অভ্যন্তরীণ ফ্রেশ ওয়াটার, ব্যালাস্ট ওয়াটারসহ সব যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রীর ওজন। গোল্ডেন ক্লাস সিরিজের জাহাজগুলোর কন্টেইনার পরিবহন ক্ষমতা ২০,১২৪ থেকে ২০,৩৮৮ টিইইউ (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট। এক একটি কন্টেনারের দৈর্ঘ্য ২০ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট এবং উচ্চতা ৮ ফুট। কার্গো জাহাজে সাধারণত ২০ ফুট ও ৪০ ফুট কন্টেইনার ব্যবহার করা হয়ে থাকে)। সুয়েজ খালে আটকেপড়া এভার গিভেনের একটি ধারণা পেতে এর মৌল ভৌত পরিসংখ্যান জানা দরকার। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১৩১২ ফুট এবং বিম ১৯২ ফুট আর ড্রাফট ৪৭ ফুট ৭ ইঞ্চি। সম্পূর্ণ কার্গোপূর্ণ অবস্থায় সাধারণ বর্ণনা অনুযায়ী জাহাজের খোল ৪৭ ফুট ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত ডুবলেও তা স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে। এর বেশি হলে জাহাজ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই জাহাজটি ২০১২৪ টিএফইউ। এই জাহাজটির মালামালপূর্ণ অবস্থায় গতি ঘণ্টায় ২২.৮ নটিক্যাল মাইল বা ৪২.২ কিলোমিটার। এর ক্রুর সংখ্যা ২৫।
সুয়েজ খালের গুরুত্ব
প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলন সহজ করে দিয়েছে সুয়েজ খাল। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের সংযোজক সুয়েজ খাল উদ্বোধন করেন মিসর ও সুদানের খতিব ইসমাইল পাশা। সেদিনই ফরাসি রানী ইউজিনের রাজকীয় জাহাজ এই খালে প্রবেশ করে। ১৯৩.৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ৯৮৪ ফুট প্রশস্ত এবং ৬২ ফুট গভীর এই খাল। ২০১৮-১৯ সালে সুয়েজ দিয়ে ৭০,৬৯টি জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে। মাল টেনেছে ৪ বিলিয়ন ২৬৪ মিলিয়ন টন আর সুয়েজের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার। একদিনে সর্বোচ্চ ৮১টি জাহাজ এবং ৬.১ মিলিয়ন টন মালামাল পরিবাহিত হয়েছে। সুয়েজ না থাকলে একটি পথই খোলা ছিল উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে আসা-যাওয়া করা। কিন্তু সুয়েজ কতটা পথ কমিয়েছে নিচের কয়েকটি পরিসংখ্যান তা স্পষ্ট করে দিয়েছে :
১. কেবল সুয়েজ খাল রটারডাম বন্দরে যাওয়ার পথ কমিয়েছে ৬৪৩৬ নটিক্যাল মাইল। উত্তমাশা হয়ে দূরত্বের ৪২ ভাগ কমেছে।
২. জেদ্দা থেকে গ্রিস থেকে ১১২০৭ নটিক্যাল মাইল জাহাজ চালাতে হতো, সুয়েজ হয়ে গেলে চালাতে হয় মাত্র ১৩১৬ নটিক্যাল মাইল। দূরত্ব কমেছে ৮৮ শতাংশ।
৩. সৌদি বন্দর থেকে নিউ ইয়র্কের দূরত্ব ছিল ১৭৭৯৪ নটিক্যাল মাইল। সুয়েজ কমিয়েছে ৩৫১৩ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব। পথ কমেছে ৩০ শতাংশ।
৪. সিঙ্গাপুর থেকে রটারডাম ১১৭৫৫ নটিক্যাল মাইল থেকে ৮২৮৮-তে নেমে এসেছে। দূরত্ব কমেছে ২৯ শতাংশ।
৫. সৌদি বন্দর রাস তানুরা থেকে ডোমিনিকান রিপাবলিকের কনস্ট্যাজা বন্দরের দূরত্ব ছিল ১২০৯৪ নটিক্যাল মাইল, সুয়েজ তা কমিয়ে এনেছে ৪১৪৪ নটিক্যালে। দূরত্ব কমেছে ৬৬ শতাংশ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সব বন্দরের মধ্যেই বিশাল দূরত্ব কমেছে। দূরত্ব কমা মানে সময় কম লাগা, কম জ¦ালানি খরচ হওয়া, অধিকসংখ্যক ট্রিপ দেওয়া সম্ভব হবে বলে কার্গো ক্যাপাসিটি বেড়ে যাওয়া, আমদানি-রপ্তানির সময় হ্রাস হওয়া সব মিলিয়ে বিশ^ অর্থনীতিতে অভাবনীয় একটি গতি সঞ্চারিত হয়। ২০১৫ সালে বর্ধিত সুয়েজ খাল জাহাজ চলাচলের জন্য খুলে দিলে খালের নেভিগেশন ক্যাপাসিটিও বেড়ে যায়।
এভার গিভেন সুয়েজের গলনালি রুদ্ধ করে দিয়েছে সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফটকাবাজার সচল হয়ে উঠল, যদি এভার গিভেন পথ ছেড়ে দেয় যদি জাহাজ জট না কাটে তাহলে তেলের বাজার কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা অনিশ্চিত। ২৯ মার্চ এভার গিভেন সুয়েজের গলনালি থেকে সরে এসেছে শোনামাত্র ক্রমাগত বাড়তে থাকা তেলের দাম পড়তে শুরু করল।
এভার গিভেন বটলনেক মেনে নিয়ে সুয়েজের দুপাশে অপেক্ষমাণ জাহাজের লোকসান বাড়তে লাগল প্রতিদিন ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এভার গিভেন আটকে পড়াতে পৃথিবী যে ধাক্কা খেয়েছে তাতে মনে করা সংগত যে, বিশ^ায়ন গ্রাউন্ডেড হয়ে গেছে। এর মধ্যে ইরান সুয়েজের বিকল্প করিডর ইরানের ভেতর দিয়ে সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলও নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বন্দর থেকে বন্দরে পৌঁছতে সুয়েজের বিকল্প ভাবার মতো ভৌগোলিক অবস্থা দৃশ্যমান নয়।
আরও বড় কন্টেইনার জাহাজ
কন্টেইনার ধারণক্ষমতাই জাহাজ কতটা বড় তা নির্ধারণ করে। আর তা মাপার ইউনিট হচ্ছে টিইইউ (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয় বড় কন্টেইনার জাহাজ হচ্ছে এইচএমএম অ্যালজিসিরাস। এর ধারণ ক্ষমতা ২৪০০০ টিইইউ। এটাকে পরিবেশবান্ধব এবং প্রযুক্তির দিক দিয়ে সর্বাধুনিক মনে করা হয়। দাইয়ু শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এর প্রস্তুতকারক। দ্বিতীয় বৃহত্তম জাহাজ এইচএমএম অসলো ২৩,৭৯২টি প্রমিত মানের কন্টেইনার ধারণ করতে পারে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ।
তৃতীয় বৃহত্তম জাহাজটিও স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি। এর ধারণক্ষমতা ২৩৭৫৬ কন্টেইনার। এই জাহাজটি ৬২ মিটার প্রশস্ত হওয়ায় এতে পাশ বরাবর ২৪টি কন্টেইনার বসানো যায়। এই জাহাজটির নাম এমএসসি গুলসুন, এর মালিকানা মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানি। চতুর্থ বৃহৎ জাহাজটিও একই কোম্পানির মালিকানাধীন, এমএসসি মিনার ধারণক্ষমতা ২৩,৬৫৬টি কন্টেইনার। নির্মাতা দাইয়ু শিপবিল্ডিং।
পঞ্চম বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ সিজিএম জ্যাকস সাদে। চায়না স্টেট শিপবিল্ডিং করপোরেশনের নির্মাণ করা এই জাহাজটি এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) চালিত। ধারণক্ষমতা ২৩০০০ টিইইউ কন্টেইনার। এটি জ্যাকস সাদে গ্রুপের ৯টি কন্টেইনারের বৃহত্তম।
ষষ্ঠ বৃহৎ জাহাজটির ধারণ ক্ষমতা ২৩০০০ ইউনিট। হংকং-এর পতাকাবাহী এই কার্গো জাহাজ পূর্ব এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপ রুটে চলাচল করে। সপ্তম অবস্থান আছে চীনের কসকো শিপিং ইউনিভার্স। ধারণ ক্ষমতা ২১,২৩৭ টিইইউ। চায়না স্টেট শিপবিল্ডিং করপোরেশনের তৈরি জাহাজটির মালিকানা এখন চায়না ওসেন শিপিং করপোরেশন (কসকো) লিমিটেডের। অষ্টম স্থানে ফ্রান্সের আন্তোইন দে সেইন্ট এক্সিউপেরি (২০৯৫৪ কন্টেইনার) এবং নবম স্থানে মাদ্রিদ মারেক (২০৫৬৮ কন্টেইনার)। উৎস : দেশ রূপান্তর।
লেখক সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামনিস্ট
momen98765@gmail.com
Leave a Reply