মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী। গতকাল বুধবার সকালে তাঁরা কাজে চলে গেলে সাত বছরের নিচের তিন শিশুসন্তানই বাড়ির পাশের রেললাইনের ওপর বসে খেলছিল। এর মধ্যেই চলে আসে ট্রেন। কাছে থাকা এক যুবক ছুটে এসে শিশুদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউই বাঁচতে পারেনি। ট্রেনে কাটা পড়ে চারজনেরই মৃত্যু হয়েছে।
নীলফামারী সদরের কুন্দপুকুর ইউনিয়নের মনসাপাড়া গ্রামের বউবাজার নামক স্থানে গতকাল সকাল ৮টার দিকে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নিহত তিন ভাই-বোন হলো লিমা আক্তার (৭), শিমু আক্তার (৪) ও মমিনুর রহমান (৩)। তারা ওই গ্রামের রিকশাচালক রোজয়ান আলী ও কারখানার শ্রমিক মজিদা বেগমের সন্তান।
নিহত যুবকের নাম সালমান ফারাজী শামীম (৩০)। তিনি মনসাপাড়া গ্রামেরই মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকালে বাড়ির পাশে রেললাইনে খেলছিল ওই তিন শিশু। এ সময় চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী রকেট মেইল ট্রেনটি নীলফামারী স্টেশন ছেড়ে সৈয়দপুর যাচ্ছিল। ট্রেন কাছাকাছি আসায় শিশু তিনটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যান শামীম। কিন্তু তাদের উদ্ধারের আগেই ট্রেন চলে আসায় কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় লিমা ও শিমু। গুরুতর আহত শামীম ও শিশু মমিনুরকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাদের মৃত্যু হয়। পরে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী রূপসা এক্সপ্রেস নামের অন্য একটি ট্রেন আটকে বিক্ষোভ করে। ট্রেনটিতে ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করে তারা। পুলিশের হস্তক্ষেপে এক ঘণ্টা পর সকাল ১১টার দিকে ট্রেনটি ছেড়ে যায়।

মনসাপাড়া গ্রামের কফিল উদ্দিন (৭০) জানান, রোজয়ান আলী রিকশাচালক। তাঁর স্ত্রী মজিদা বেগম একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। প্রতিদিন সকালে বাড়িতে সন্তানদের রেখে কাজে চলে যান তাঁরা। এদিন তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার কবল থেকে শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে শামীমের মৃত্যু হয়। কফিল উদ্দিন বলেন, ‘দুর্ঘটনাস্থলে রেলের একটি সেতুর সংস্কারকাজ চলছে। ওই সংস্কারকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকায় শামীম সেখানে অবস্থান করছিলেন। চোখের সামনে শিশুদের বিপদ দেখে শামীম তাদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।’
পরে নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ লোকজনকে শান্ত করেন। সৈয়দপুর রেলওয়ে থানার ওসি আব্দুর রহমান বলেন, ‘দুপুর ১টার দিকে দাফনের জন্য পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।’
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ জানান, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তিন সন্তান হারানো রোজয়ান আলীর পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা এবং শামীমের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

রোজয়ান-মজিদা দম্পতি সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে, তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছিলেন। স্বপ্ন ছিল, তিন সন্তান লেখাপড়া শিখবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কিন্তু নিমেষেই একটি দুর্ঘটনা চুরমার করে দিল সব স্বপ্ন।
সন্তানদের জন্য রোজয়ানের স্ত্রী মজিদা বেগমও শ্রমিকের কাজ নিয়েছিলেন জেলা শহরে চীনের একটি কম্পানির কারখানায়। ভালোই দিন কাটছিল তাঁদের। বড় মেয়ে লিমা আক্তারকে ভর্তি করিয়েছিলেন শিশু শ্রেণিতে।
দুর্ঘটনার পর ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে মাতম। একই সময়ে চার লাশের শোক যেন বহন করতে পারছিল না গ্রামের মানুষ। শিশুদের মা ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুদের নানি হাসিনা বেগম (৫৫) আদরের নাতি-নাতনিদের শোকে প্রলাপ বকছিলেন। এরই মধ্যে তিনি বলেন, ‘তিনটা ছাওয়াক নিয়া হামেরা মেলা স্বপন দেখিবার শুরু করিছি। আল্লাহ কেনে যে ওমান ধরি গেইল, হামার এলা কী হইবে। ছাওয়ালার মা-বাবা এই শোক কী করিয়া পাশুরিবে, ও আল্লা এলা কী হইবে…।’

রোজয়ান আলী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন একই সঙ্গে শোয়ানো তিন সন্তানের দিকে। একসময় কথা বলতে সক্ষম হন। জানান, নাশতা শেষে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন তাঁরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্ঘটনার খবর আসে তাঁদের কাছে। ঘটনার পর অসুস্থ স্ত্রী মজিদাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘মুই এলা কী করিম, কেমন করি বাঁচি থাকিমো হামেরা। মোর তামান স্বপন যে শ্যাষ হইল।’
গ্রামবাসী জানায়, শামীম ছিলেন পরোপকারী এক যুবক। গ্রামের কেউ অসুস্থ হওয়ার খবর এলেই তাকে নিয়ে ছুটতেন হাসপাতালে। বুধবার সকালেও ওই তিন শিশুকে ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ট্রেন যখন প্রায় কাছাকাছি, তখনো অবুঝ তিন শিশু খেলছিল রেললাইনে। শামীম ছুটে গিয়ে এক শিশুকে কোলে তুলে সরে আসার সময় ট্রেনের ধাক্কায় লাইনে পড়ে আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
শামীমের ভায়রা, জেলা শহরের নিউ বাবুপাড়ার আকরাম হোসেন (২৭) বলেন, শামীম একসময় ঢাকায় এফডিসিতে চাকরি করতেন। সেখানে চাকরির সুবাদে কয়েটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। সেখান থেকে দুই বছর আগে বাড়ি এসে সংসার দেখাশোনা করছিলেন। এরই মধ্যে তাঁকে বউবাজারে রেলপথে সেতুর সংস্কারকাজ দেখাশোনার দায়িত্ব দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বুধবার সকালেও তিনি দায়িত্ব পালনে সেখানে অবস্থান করছিলেন। আকরাম বলেন, ‘এলাকার যেকোনো মানুষের বিপদে তাঁকে এগিয়ে যেতে দেখেছি। কোনো মানুষ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া নেশায় পরিণত হয়েছিল তাঁর।’

শামীমের মামি রুমি আক্তার জানান, শামীম সাত বছর আগে সুমি আক্তারকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে মিত্তাহুল জান্নাত নামের ছয় বছরের এক মেয়েসন্তান রয়েছে। শামীমের বাবা আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন অনেক আগে। স্ত্রী, মেয়ে ও মা চিনু বেওয়াকে নিয়ে তাঁর পরিবার।
Leave a Reply