সড়ক দুর্ঘটনা ১৩.১১ শতাংশ, নিহত ১৪.৩৮
শতাংশ ও আহত ৪.৮৫ শতাংশ বেড়েছে
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরেও বিদায়ী ২০২১ সালে ৫৬২৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮০৯ জন নিহত, ৯০৩৯ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ৪০২ টি দুর্ঘটনায় ৩৯৬ জন নিহত, ১৩৪ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ১৮২ টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত, ৫৭৮ জন আহত এবং ৫৪৪ জন নিখোঁজ হয়েছে। সড়ক, রেল, নৌ-পথে সর্বমোট ৬২১৩ টি দুর্ঘটনায় ৮৫১৬ জন নিহত এবং ৯৭৫১ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
আজ ২৩ জানুয়ারী রবিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্র সমূহে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনা কবলে পড়েছে ২৩৫০ জন চালক, ১৭১৫ জন পথচারী, ১০১৭ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৪৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী, ১১১ জন শিক্ষক, ২৩৭ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১০৭৬ জন নারী, ৬৩৮ জন শিশু, ৪২ জন সাংবাদিক, ২৭ জন চিকিৎসক, ১৪ জন আইনজীবী ও ১৮ জন প্রকৌশলী এবং ১৬১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
এর মধ্যে ১৪৩১ জন পথচারী, ২৬ জন সেনা সদস্য, ৫২ জন পুলিশ, ০৪ জন আনসার সদস্য, ০৫ জন র্যাব সদস্য, ০৬ জন বিজিবি সদস্য, ০১ জন বিমানবাহিনীর সদস্য, ০৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১২ জন সাংবাদিক, ৭১৩ জন নারী, ৪৮১ জন শিশু, ৩২৯ জন শিক্ষার্থী, ৮৯ জন শিক্ষক, ১৮১৫ জন চালক, ৪৩১ জন পরিবহন শ্রমিক, ১৪ জন প্রকৌশলী, ১১ জন আইনজীবী, ৮৫ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ১৮ জন চিকিৎসক নিহত হওয়ার খবর দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকায় প্রাকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতি জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ। এসব হতাহতদের ৭৮.৩৯ শতাংশ ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে ৫৫৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭১ জন নিহত, ৯২২ জন আহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসে ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫৬ জন নিহত, ৭৫০ জন আহত হয়েছে। মার্চ মাসে ৫০৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৬ জন নিহত, ৮৫৬ জন আহত হয়েছে। এপ্রিল মাসে ৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৮ জন নিহত, ৫০৭ জন আহত হয়েছে। মে মাসে ৫৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১৫ জন নিহত, ১০০৮ জন আহত হয়েছে। জুন মাসে ৪৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৬ জন নিহত, ৭৬২ জন আহত হয়েছে। জুলাই মাসে ৪১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৫ জন নিহত, ৬৬৯ জন আহত হয়েছে। আগস্ট মাসে ৪০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩২ জন নিহত, ৬১৬ জন আহত হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ৪০৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪১ জন নিহত, ৭৩৫ জন আহত হয়েছে। অক্টোবর মাসে ৪৭৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০৬ জন নিহত, ৭৫৮ জন আহত হয়েছে। নভেম্বর মাসে ৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৩ জন নিহত, ৭০৫ জন আহত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ৪৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৩ জন নিহত, ৭৫১ জন আহত হয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১৩.১১ শতাংশ, নিহত ১৪.৩৮ শতাংশ ও আহত ৪.৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লেখিত সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৭৭৩০টি যানবাহনের পরিচয় গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে, যার ৩০.৪২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ডভ্যান, ২৫.৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১০.৭৬ শতাংশ বাস, ৯.৬৪ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা ৮.৭৩ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ৮.৬৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিক্সা, রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক, ৬.১৭ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
সংগঠিত মোট দুর্ঘটনার ৫৪.০৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২২.১৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬.১৩ শতাংশ খাদে পড়ে, ৬.২১ শতাংশ বিবিধ কারনে, ০.৫৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে এবং ০.৮৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত যানবাহনের ০.৭৯ শতাংশ মোটরসাইকেলে, ০.৭৬ শতাংশ কার-জীপ-মাইক্রোবাসে ০.২১ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ২.৩৬ শতাংশ বাস দুর্ঘটনা, ১ শতাংশ নসিমন-মাহিন্দ্রা-লেগুনা দুর্ঘটনা, ০.৪ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিক্সা-ভ্যান-ইজিবাইকে দুর্ঘটনা কমেছে।
পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, ২০২০ সালের তুলনায় বিদায়ী ২০২১ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা ১.১১ শতাংশ, ট্রেন যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ০.০৬ শতাংশ, মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ০.১১ শতাংশ, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নিহতের ঘটনা ০.১৯ শতাংশ বেড়েছে। নিয়ন্ত্রণ হায়িয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ০.৯৫ শতাংশ ও অন্যান্য বিবিধ ঘটনা ০.৫ শতাংশ কমেছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩১.৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৯.২৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২০.৩৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫.৩১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২.৬৬ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৮৭ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় ০৩ মাস গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরেও বিগত বছরের চেয়ে বিদায়ী বছরে জাতীয় মহাসড়কে ২.৫৮ শতাংশ, ফিডার রোডে ১.২৩ শতাংশ, রেলক্রসিং এ ০.০৬ শতাংশ দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে তবে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫.৪ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে।
বিগত ০৭ বছরে ৩৭৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৬৬৫ জন নিহত ও আহত হয়েছে ১০০৩৯৭ জন। পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫ সালে ৬৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৬৪২ জন নিহত, ২১৮৫৫ জন আহত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৫৫ জন নিহত, ১৫৯১৪ জন আহত হয়েছে। ২০১৭ সালে ৪৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৯৭ জন নিহত, ১৬১৯৩ জন আহত হয়েছে। ২০১৮ সালে ৫৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭২২১ জন নিহত, ১৫৪৬৬ জন আহত হয়েছে। ২০১৯ সালে ৫৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৫৫ জন নিহত, ১৩৩৩০ জন আহত হয়েছে। ২০২০ সালে ৪৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৬৮৬ জন নিহত, ৮৬০০ জন আহত হয়েছে। ২০২১ সালে ৫৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮০৯ জন নিহত, ৯০৩৯ জন আহত হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার কারণসমূহ :
১। বেপরোয়া গতি। ২। বিপদজনক অভারটেকিং। ৩। রাস্তাঘাটের ত্রুটি। ৪। ফিটনেসবিহীন যানবাহন। ৫। যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা। ৬। চালকের অদক্ষতা। ৭। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার। ৮। মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো। ৯। রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা। ১০। রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা। ১১। ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ। ১২। ছোট যানবাহন বৃদ্ধি। ১৩। সড়কে চাঁদাবাজি। ১৪। রাস্তার পাশে হাট-বাজার। ১৫। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো। ১৬। দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারীচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারনে সড়ক দুর্ঘটনা বেপরোয়াভাবে বাড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশমালা :
১. সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা।
২. আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।
৩. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানো, সড়ক মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন।
৪. সড়ক নিরাপত্তায় ইত্যিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন উদ্যোগ নেওয়া।
৫. দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অংকন করা।
৬. গণপরিবহন চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৭. সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাদাঁবাজি বন্ধ করা।
৮. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে আধুনিকায়ন করা।
৯. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনপূর্বক হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
১০. দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেয়া ।
১১. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা।
১২. গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, বুয়েট দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবদুল হক, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
Leave a Reply