পাবলিক বাসে উঠে নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিটে পুরুষদের দেখলে মাথা খানিকটা বিগড়েই যায়। তবে বেশি বিগড়ে যায় নারীদের দাঁড়িয়ে রেখে পুরুষরা যখন নারীদের সিটে গেড়ে বসে থাকে। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রায়ই বাকযুদ্ধ হয়। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক যাত্রীদের চোখে ঝগড়াটে খেতাবও জোটে। তারপরও এতে অন্তত প্রতিবাদহীন নারীরা সাহস পায় অসহায়ত্ব থেকে বেরুতে। ঢাকায় এভাবেই বরাবর যাতায়াত করে আসছি। তবে আমার সেই প্রতিবাদের ভাষায় বড় একটা চপেটাঘাত খেয়েছি শনিবার (৩০ এপ্রিল, ২০২২)। যা বলতে বা লিখতেও ঘৃণা লাগছে।
বিকেলে রমজান বাসে করে মৌচাকে অফিসে যাচ্ছিলাম। সিট না পেয়ে বসছিলাম ইঞ্জিন কাভারে। পাশেই এক পুরুষ। বসার সঙ্গে সঙ্গেই তার মধ্যে নড়াচড়া শুরু হলো। হাতপা, শরীরের ইঞ্চি মনে হয় বাড়তে লাগলো। যতই নিজেকে সরে আনি ততই উনি হেলে পড়েন। বললাম, সরে বসুন। কিন্তু কোনো বিকার নেই। এমন অস্বস্তি নিয়েই কাকরাইল পর্যন্ত গেলাম। সেখানে তিনি নেমে গেলেন বটে তবে আরেক পুরুষ উঠলেন। ঠিক একই জায়গায় বসে পড়লেন। এবারের তিনি আরো কয়েকগুণ। কথা বলতেই জ্বলে উঠলেন। বললেন, এত যদি সমস্যাই হয়, তাহলে প্রাইভেট কারে যান না।
এভাবে তর্কতর্কির মধ্যেই আরেকজন উঠলেন। দেখলাম তিনি ঘুরে সামনের সিটে বসা এক নারীর মুখোমুখি হলেন। তার এক পা নারীর দুই হাঁটুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বললাম, এটা কী করছেন? আপনি ঠিক হয়ে বসুন। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এটা কোনো সমস্যা না। বললাম, মানে? মানে পরিষ্কার, এটা কোনো সমস্যা-ই না। নারীটাও বেশ স্বাভাবিক। কোনো হেলদোল নেই। কিন্তু লোকটা আমার সঙ্গে তর্ক করতেই থাকল। এর মধ্যে এক দাঁড়িওয়ালা মাথায় টুপি, বেশ হোমড়া চোমড়াটাইপ লোক উঠলেন। উঠতে উঠতেই বললেন, কী হয়েছে? আমার পাশেরজন ইনিয়ে বিনিয়ে বর্ণনা করলেন। উনি কথাবার্তা ছাড়াই ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠলেন। যেন তার মাথার মধ্যে একশটা মেসের কাঠি একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে। বলা শুরু করলেন, যারা বাসে উঠে মহিলা সিট নিয়ে কথা বলে তাদের প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়া উচিত…। যেন কথার খই ফুটল। পাবলিক বাসে উঠলে গায়ের সঙ্গে গা, হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু লাগবেই। এটা কোনো সমস্যাই না।
এবার পাশেরজন দাঁত কেলিয়ে বললেন, দেখছেন, উনিও বলছেন এসব কোনো সমস্যা নয়। তাহলে আপনার সমস্যা কেন? মজার ঘটনা হচ্ছে, যে মেয়েটার জন্য এতোক্ষণ ধরে বাকবিতণ্ডা, হেনস্থা চলছিল, সেই মেয়েটাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে বসল, এটা পাবলিক বাস। এখানে গা লাগতেই পারে। ইনি আমার হাঁটুতে ঢুকে গেছেন- তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনার লাগছে কেন?
এবার লোকটা এবং হঠাৎ উড়ে এসে তর্কে জড়িয়ে পড়া বুড়োটা আমার ওপর আরো চড়াও হয়ে উঠল। যেন তপ্ত খোলায় গরম পিঠা। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বুড়োটা উত্তেজিত গলায় আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন, আমি কে জানেন? আমি কে জানেন? বললাম, জানি না। তিনি বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এরপর তেড়ে এসে বললেন, চাইলে আপনার মতো মহিলাকে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি। বলতে বলতেই ‘মহিলার সিট’ লেখাটির ওপর তুমুল আক্রোশে থাবা দিলেন। ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন।
উল্টো আমিও বললাম, আমিও চাইলে আপনার মতো লোককে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারি। তিনি বললেন, মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। আমিও বললাম, মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। তিনি আবারও বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক…। আমি এবার বাধ্য হয়ে নিজের পরিচয়টা দিলাম। যেটা সচরাচর কখনওই করি না। সাংবাদিক পরিচয় শুনে এবার তিনি ‘তুমিতে’ নামলেন। বললেন, তোমার মতো সাংবাদিক পথে ঘাটে হাঁটে। বললাম, খবরদার, আমার পেশা নিয়ে কথা বলবেন না। আপনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও আমাদের চেনা আছে। আপনারা নারীদের রেপ করেন। তিনি বললেন, মুখ সামলে কথা বলো। আমি বললাম, আপনি সিনিয়র মানুষ আর লিমিট ক্রস করবেন না। উপরে ভাব দেখালেও সাংবাদিক শুনে গজগজানি কমল বলে মনে হলো। গলার স্বর খানিকটা মুদরায় নামল। গজ গজ করতে করতে গিয়ে বসলেন সেই মহিলাদের নির্ধারিত সিটেই।
কথার ফাঁকে ৯৯৯-এ ফোন দেয়ার কথা বলতেই হতবাক করে দিয়ে মেয়েটি অশ্লীল ভাষায় বলল, ৯৯৯-কি …ছিঁড়তে পারে আমার জানা আছে। আমি বললাম, ৯৯৯ অনেক কিছু ছিঁড়েছে তা আমারও জানা আছে। তাকে বললাম, চুপ করো, তোমার মতো মেয়েদের জন্যই এরা নারীদের অপমান করতে প্রশ্রয় পায়। আজও পেল। পাশের এক সিনিয়র নারী বললেন, আপনার এভাবে প্রতিবাদ করে কী হলো? যার জন্য প্রতিবাদ করলেন, হেনস্থা হলেন- সে-ই উল্টো আপনার বিরুদ্ধে গেল। তিনি আরও বললেন, আপনার মতো আমার মেয়েও সাংবাদিক। আপনাকে অপমান করছে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে।
এর মধ্যেই বাস পৌঁছে গেল মৌচাকে। নামতে নামতে হেলপারকে বললাম, তোমাদের বাসে শিক্ষক নামের এই টেররিস্ট, জঙ্গি উঠে মহিলাদের সিটে বসে তাদেরই অপমান করছে। তোমরা তো কিছুই বলো না? সে বলল, মহিলার সিটে বসতে মানা করলেও শোনে না। আমাদের অপমান করে। কী করব ম্যাডাম? অফিসে গিয়ে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে ঘটনাটা শেয়ার করলাম। তারা কষ্ট পেল, দুঃখপ্রকাশ করল। বলল, কতিপয় নারীর কারণে আমাদের এভাবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও মাথাটা কাজ করছে না। তবে এখন মনে হচ্ছে, আমার কপালে টিপ এবং গেটাপ দেখেই যে ওই লোকটি এমন আগ্রাসি আচরণ করেছেন. সেটা নিশ্চিত। নারীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো যেমন হয়রানী, তেমনি মহিলা সিটে পুরুষ বসলেও বিধান আছে জরিমানার। শুধু মনিটরিং বা আইনের প্রয়োগ না থাকার কারণেই নারীদের হেনস্থা হতে হচ্ছে। পরে ভাবলাম, ঢাকা ভার্সিটির প্রোভিসি কবি সামাদ ভাইকে ফোন দিয়ে সহায়তা নিতে পারতাম ওই আগ্রাসী লোকটির শিক্ষক পরিচয় নিশ্চিত হতে। আবার ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে আইনের সহায়তাও তো নেয়া যেত। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় এতোটাই আবেগ এবং ক্ষোভ ছিল যে, সেটা মাথায় আসেনি। কেন জানি মনে হচ্ছে, উন্নয়নের অবকাঠামোর জঙ্গলে ভরে ওঠা এই মহানগরীতে জংলি মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
Leave a Reply